প্রশ্ন: নারীরা কী পুরুষদের মতো নামায পড়বে? নাকি তাদের পৃথক নামাযের পদ্ধতি আছে?
(২) নারীদের নামাযে পদ্ধতিগতভাবে পুরুষদের থেকে কিছু পার্থক্য রয়েছে৷ নারী-পুরুষের শারীরীক গঠন, সক্ষমতা, নিরাপত্তা, সতর ও পর্দা ইত্যাদি নানা বিষয়ে যেমন পার্থক্য রয়েছে, ঠিক তেমনি ইবাদতের ক্ষেত্রেও কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত৷
ইসলামের অধিকাংশ বিধানেও নারী-পুরুষের পার্থক্য রাখা হয়েছে৷ পুরুষকে নারীদের এবং নারীদের পুরুষের সামঞ্জস্য এবং সাদৃশ্য ধারণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে৷ এক হাদীসে এসেছে-
ﻟَﻌَﻦَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﺍﻟﻤُﺘَﺸَﺒِّﻬِﻴﻦَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺮِّﺟَﺎﻝِ ﺑِﺎﻟﻨِّﺴَﺎﺀِ، ﻭَﺍﻟﻤُﺘَﺸَﺒِّﻬَﺎﺕِ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀِ ﺑِﺎﻟﺮِّﺟَﺎﻝِ.
অর্থ: রাসূলুল্লাহ ﷺ অভিশাপ দিয়েছেন, যেই পুরুষরা মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং যে মহিলারাও পুরুষদের সদৃশ্য অবলম্বন করে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-৫৮৮৫)
নারীদের নামাযে পদ্ধতিগত পার্থক্যের বিবরণ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বর্ণনা থেকে-
عن يزيد بن أبي حبيب، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على امرأتين تصليان فقال: إذا سجدتما فضمَّا بعض اللحم إلى الأرض؛ فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل.
অর্থ: তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব রাহ. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ নামাযরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্যে) বললেন, যখন সাজদা করবে, তখন শরীর যমীনের সাথে মিলিয়ে দিবে৷ কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়৷
(কিতাবুল মারাসীল, ইমাম আবু দাউদ হাদীস নং-৮০, আস-সুনানুল কুবরা বাইহাকী হাদীস নং-৩০১৬, ২/২২৩, হাদীসটি ইমামগণের উসূল অনুযায়ী দলীলযোগ্য- নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান, আওনুল বারী: ১/৫২০, মুহাদ্দিস শুয়াইব আল-আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন৷)
পার্থক্যের বিবরণ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমার বর্ণনা থেকে-
عَنْ بُكَيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ الأَشَجِّ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ؛ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ صَلاَةِ الْمَرْأَةِ؟ فَقَالَ: تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِزُ. (مصنف ابن ابى شيبة، كتاب الصلاة، في المرأة كَيْفَ تَجْلِسُ فِي الصَّلاَةِ، رقم الحديث-2794)
অর্থ: বুকাইর ইবনু আবদিল্লাহ থেকে বর্ণিত, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমাকে জিজ্ঞেস করা হলো- মহিলারা কিভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন- খুব জড়োসড়ো হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে। (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৪)
তাই নামাযের কতিপয় পদ্ধতি যেমন- তাকবীরে তাহরীমার জন্যে হাত উঠানো, হাত বাঁধা, রুকু, সাজদা, বৈঠক ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে পুরুষের সাথে নারীর পার্থক্য রয়েছে৷ যে পার্থক্যের বিবরণ খোদ রাসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছেন৷ সাহাবায়ে কেরাম দিয়েছেন৷
নামাযে হাত উঠানো বিষয়ক পার্থক্য-
عن وائل بن حجر قال: قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم: يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها (المعجم الكبير، باب الواو رقم الحديث-28)
অর্থ: হযরত ওয়াইল বিন হুজর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন। আমাকে নবীজী ﷺ বলেছিলেন যে, হে ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর।
(আল মুজামুল কাবীর, হাদিস নং-২৮, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা: ১/২৩৯, মুনতাখাব কানযুল উম্মাল আলা হামিশি মুসনাদে আহমদ: ৩/১৭৫, মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ২/১০৩, হাদিসটির সনদ হাসান।)
سُئِلَ عَطَاءً عَنِ الْمَرْأَةِ كَيْفَ تَرْفَعُ يَدَيْهَا فِي الصَّلَاةِ، قَالَ: حَذْوَ ثَدْيَيْهَا.
অর্থ: হযরত আতা ইবনু আবী রাবাহ রাহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো, নামাযে মহিলা কতটুকু হাত উঠাবে? তিনি বললেন, বুক বরাবর৷ (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা: ২৪০১, ১/২৭০)
وإذا أراد الدخول في الصلاة كبر ورفع يديه حذاء أذنيه والمرأة أنها ترفع حذاء منكبيها.
অর্থ: যখন নামায শুরু করতে চাইবে, তাকবীর বলবে এবং দুই হাত কান বরাবর উঠাবে৷ আর মহিলা হাত উঠাবে কাঁধ বরাবর৷ (আল-বাহরুর রায়িক: ১/৩০৫)
হাত বাঁধার স্থান বিষয়ক নারী-পুরুষের পার্থক্য:
পুরুষরা হাত নাভীর নিচে বাঁধবে, আর নারীরা বুকের উপর হাত বাঁধবে৷ যদিও পুরুষদের নাভীর উপরে হাত বাঁধার বিবরণও রয়েছে, কিন্তু অগ্রাধিকারযোগ্য মত হলো, পুরুষরা নাভীর নিচে হাত বাঁধবে৷ আর নারীরা বুকের উপর৷
عن علقمة بن وائل بن حجر، عن أبيه قال: رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.
অর্থ: হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি নবী কারীম ﷺকে দেখেছি, তিনি নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নীচে রেখেছেন। (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা, হাদীস নং- ৩৯৫১)
عن أبي جحيفة أن عليا رضي الله عنه قال: السنة وضع الكف على الكف في الصلاة تحت السرة.
অর্থ: হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুন্নাহ হচ্ছে নামাযে হাতের পাতা হাতের পাতার উপর নাভীর নিচে রাখা।(মুসনাদে আহমদ হাদীস নং- ৮৭৫, আবু দাউদ হাদীস নং- ৭৫৬, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা হাদীস নং- ৩৯৬৬)
بخلاف المرأة فإنها تضع علي صدرها، لأنه أستر لها فيكون في حقها أولي.
অর্থ: ঠিক বিপরীত হলো নারীদের বিষয়টি, তারা হাত রাখবে বুকের উপর৷ কেননা এটা তাদের জন্য অধিক আবরণকারী এবং তাদের জন্য সর্বোত্তম৷ (ই’লাউস সুনান: ২/১৫৩)
وأما المرأة فإنها تضعهما تحت ثدييها بالإتفاق لأنه استر لها
অর্থ: উম্মতের ইজমা হলো, মহিলা হাত বাঁধবে বুকের নিচে৷ কেননা এটা তাদের জন্য অধিক আবরণকারী৷ (গুনইয়াতুল মুতামাল্লী কাবীরী পৃষ্ঠা: ২৯৪)
সাজদার পদ্ধতিগত পার্থক্য:
পুরুষ এমনভাবে সাজদা করবে যে, পেট উরু থেকে এবং হাতকে পার্শ্ব থেকে পৃথক রাখবে৷ এবং কনুই জমিন থেকে আলাদা রাখবে৷ আর নারীরা পেটকে উরুর সাথে এবং হাতকে পার্শ্বের সাথে মিলিয়ে রাখবে৷ এবং কনুইকে জমিনের উপর বিছিয়ে রাখবে৷
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم: إِذَا جَلَسْت الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا
অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত রাসূল ﷺ ইরশাদ করেছেন- মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে, তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সাজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে, যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। (সুনানে বায়হাকী-২/২২৩, হাদিস নং-৩৩২৪, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা: ১/২৭০, কানযুল উম্মাল: ৮/২২৩, হাদিসটির সনদ হাসান।)
বসার পদ্ধতিগত পার্থক্য:
পুরুষ তো নামাযে এমনভাবে বসবে যে, ডান পায়ের পাতা দাঁড়ানো থাকবে আর বাম পা বিছিয়ে এর উপর বসবে৷ আর মহিলারা তাদের উভয় পা ডানদিকে বের করে নিতম্বের উপর বসবে৷
عن عائشة رضي الله عنها قالت كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يفتتح الصلاة بالتكبير… وكان يفترش رجله اليسري وينصب اليمني.
আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ নামায তাকবীর বলে শুরু করতেন৷… আর বাম পা বিছিয়ে বসতেন এবং ডান পা দাঁড়িয়ে রাখতেন৷ (সহীহ মুসলিম হাদীস নং-৪৯৮, আবু দাউদ হাদীস নং-৭৮৩, মুসনাদে আহমাদ হাদীস নং-২৪০৩০)
عَن خَالِدِ بْنِ اللَّجْلاَجِ ، قَالَ : كُنَّ النِّسَاءُ يُؤْمَرْنَ أَنْ يَتَرَبَّعْنَ إذَا جَلَسْنَ فِي الصَّلاَةِ ، وَلاَ يَجْلِسْنَ جُلُوسَ الرِّجَالِ عَلَى أَوْرَاكِهِنَّ ، يُتَّقي ذَلِكَ عَلَى الْمَرْأَةِ ، مَخَافَةَ أَنْ يَكُونَ مِنْهَا الشَّيءُ.
খালিদ ইবনুল-লাজলাজ রাহ. বলেন- মহিলাদেরকে আদেশ করা হতো যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মত না বসে। আবরণযোগ্য কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় মহিলাদেরকে এমনি করতে হয়। (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা-১/৩০৩, হাদিস নং-২৭৯৯)
والمرأة علي إليتها اليسري في القعدتين وتخرج كلتا رجليها من الجانب الآخر أي الأيمن؛ لأن ذالك أستر لها.
অর্থ: মহিলা নামাযে বসবে বাম নিতম্বের উপর আর দুই পা ডানদিকে বের করে রাখবে৷ এটাই তাদের সতরের জন্য অধিক উপযোগী। (গুনইয়াতুল মুতামাল্লী কাবীরী পৃষ্ঠা: ২৯৪)
উপরে নামাযের বিভিন্ন অবস্থার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ থেকে বোঝা গেলো, নারী-পুরুষের নামাযে পদ্ধতিগত অনেকগুলো পার্থক্য রয়েছে৷ তাই নারীরা নারীদের নিয়মেই নামায আদায় করবে৷ পুরুষের মতো করে নয়৷
তবে যে সমস্ত মা-বোন ইতোমধ্যে পুরুষের মতো একই পদ্ধতিতে নামায আদায় করেছেন, তাদের নামাযও বাতিল হয় নাই৷ কেননা এগুলো নামায বাতিল বা নষ্ট হওয়ার মতো বিষয় নয়৷ তবে অবশ্যই নিয়ম পরিপন্থী হয়েছে৷ তাই ভবিষ্যতে নারীদের জন্য শরীয়ত বিবৃত পৃথক নিয়মেই নামায আদায় করা উচিত৷
واللہ تعالٰی أعلم بالصواب.
উত্তর প্রদানে-
মুফতি জিয়াউর রহমান
Leave a Reply