বিয়ের পূর্বে কনে দেখার গুরুত্ব ও ইসলাম

বিয়ের পূর্বে কনে দেখা

মুফতি জিয়াউর রহমান

বিয়ে করার ক্ষেত্রে কনে দেখা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ পরবর্তী দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি এখান থেকেই শুরু। তাই কনে দেখার আগে ঠিক করে নেবেন আপনি বিয়ে কেন করছেন? সাময়িক সুখ লাভের জন্য? নাকি বিয়ের মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী কোনো প্ল্যান আছে?

অবশ্যই মুমিন প্ল্যান ছাড়া কোনো কাজ করতে পারে না।

প্ল্যান-১. বিয়ের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً.
অর্থ: তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন৷ (সুরা রুম: ২১)

প্ল্যান-২. বিয়ের মাধ্যমে চোখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজত। চরিত্রের হেফাজত। জীবন ও যৌবনকে পবিত্র রাখা।

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ

অর্থ: হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-৪৭৭৮, সহীহ মুসলিম হাদীস নং-১৪০)

প্ল্যান-৩. অধিক সন্তানের মাধ্যমে নবীজির খাঁটি উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি।
রাসূলুল্লাহ ﷺ অধিক সন্তান দানকারী নারীদের বিয়ে করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন৷ এটাই প্রমাণ করে শরীয়তে অধিক সন্তান হওয়া কাম্য৷ কম সন্তান হওয়া কাম্য নয়৷ যদি সবকিছুর এখতিয়ার আল্লাহ তাআলার হাতে৷

নাবী কারীম ﷺ বলেছেন-

تزوَّجوا الوَدودَ الولُودَ فإنِّي مُكاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ.

অর্থ: তোমরা এমন মেয়েদেরকে বিবাহ কর, যারা পতিপরায়ন ও অধিক সন্তান প্রসবকারীনী হয়৷ (অর্থাৎ এমন বংশ বা পরিবারের মেয়ে বিবাহ করো, যে বংশ বা ররিবারের মেয়েরা বেশী সন্তান ধারণ করে) কেননা, কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের দ্বারা উম্মতের আধিক্য নিয়ে অন্য উম্মতদের মাঝে গর্ব করবো৷ (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং-১২৬৩৪)

হাদিসে কনে দেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে৷ রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

إِذَا خَطَبَ أَحَدُکُمْ الْمَرْأَةَ فَإِنْ اسْتَطَاعَ أَنْ يَنْظُرَ إِلَی مَا يَدْعُوهُ إِلَی نِکَاحِهَا فَلْيَفْعَلْ.
অর্থ: তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোনো নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দিবে, তখন তার কোনো সৌন্দর্যের দিকে তাকানো সম্ভব হলে, তা যেন দেখে নেয়৷ (মুসনাদে আহমদ: ১৪৬২৬, আবু দাউদ: ২০৮২)

আনাস রাযি. বলেন-
أَنَّ الْمُغِيرَةَ بْنَ شُعْبَةَ أَرَادَ أَنْ يَتَزَوَّجَ امْرَأَةً فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صلی الله عليه وآله وسلم اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا فَإِنَّهُ أَحْرَی أَنْ يُؤْدَمَ بَيْنَکُمَا فَفَعَلَ فَتَزَوَّجَهَا فَذَکَرَ مِنْ مُوَافَقَتِهَا .
মুগীরা ইবনে শুবা রাযি. এক নারীকে বিয়ে করার ইচ্ছা করলেন৷ রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বললেন, যাও গিয়ে দেখো৷ কেননা আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে প্রীতির সৃষ্টি হবে৷ তিনি তা-ই করলেন৷ এরপর তিনি ওই নারীকে শাদি করে নিলেন৷ পরে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে তাদের সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্কের আলোচনা করলেন৷ (মুসনাদে আহমদ: ১৮১৭৯, নাসাঈ: ১৮৬৫)

কনে দেখার ক্ষেত্রে বর নিজে না গিয়ে পরিবারের নারীদের পাঠিয়েও দেখার কাজ সম্পন্ন করতে পারে৷ নারীদের থেকে পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া গেলে পরে বর গিয়ে দেখবে৷

وإذا لم یمکنه النظر استحب أن یبعث امرأة یثق بہا تنظر إلیہا وتستخبرہ۔ (فتح الملہم ۳/۴۷۶رشیدیة
অর্থ: বরের জন্য কনে দেখা যদি সম্ভব না হয়, তখন মুস্তাহাব হলো, এমন নারীকে পাঠানো, যার দেখা ও সংবাদের উপর বর নির্ভর করতে পারে৷ (ফতহুল মুলহিম: ৩/৪৭৬)

কনে দেখার ক্ষেত্রে এখানে কয়েকটি বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার-

এক. কনে দেখা হবে সর্বশেষ প্রক্রিয়া৷ এর আগে জানাশোনার অন্যান্য বিষয় ও প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে হবে৷ আমাদের সমাজে প্রথমেই কনে দেখা হয়৷ এমনটা ঠিক নয়৷ পরবর্তীতে কোনো কারণে বিয়ে না হলে কনে ও তার পরিবারের জন্য লজ্জা ও বিব্রত হওয়ার কারণ ঘটে৷

দুই. কনে দেখার ক্ষেত্রে যত কম আনুষ্ঠানিকতা হবে, ততই ভালো৷ বরং উত্তম তো হলো, পাত্র যে কোনো উপায়ে চুপিসারে কনেকে দেখে নিবে৷ কিংবা পারিবারিকভাবে গিয়ে দেখে নেবে৷ তবে এই দেখা হতে হবে বিয়ের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া হিসেবে৷

তিন. যারা অনেক জায়গা দেখেছেন, কিন্তু উপযুক্ততার নিজের বানানো কতিপয় মাপকাঠি নিয়ে দেখেছেন৷ আল্লাহর ওয়াস্তে শরীয়ত কৃত মাপকাঠি ছাড়া বংশ, আঞ্চলিকতা, এরিয়া, সীমানায় ঘুরপাক খেয়ে সময় নষ্ট করবেন না৷ উপযুক্ত জায়গাগুলো হারাবেন না৷

চার. বিয়েতে ‘কুফু’ বা পরস্পরে সমতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ কিন্তু আমাদের নিজেদের তৈরি বা বৃটিশের দেয়া বংশবৈষম্যকে আমরা কুফু মেনে শরীয়তের নামে জাহিলিয়াতের চর্চা করে যাচ্ছি৷ যার কারণে বিয়েটাকে কঠিন করে দিয়েছি৷ কিন্তু ইসলামে কুফু বা সমতার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- দ্বীন৷

ছেলে এবং মেয়ের দ্বীনদারিতায় সমতা রক্ষা হলেই কুফুর প্রধান শর্ত পাওয়া গেলো৷ কিন্তু আমরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে ফেলেছি৷ তবে হ্যাঁ কুফু বা সমতার অন্যান্য পারিপার্শ্বিক বিষয়ও একান্ত প্রয়োজনে খেয়াল করা যায়৷ এগুলোও গুরুত্বহীন নয়৷ তবে মনে রাখতে হবে এগুলো কুফুর মূল শর্তের অন্তর্ভুক্ত নয়৷

কনে দেখার সময় যে কয়টি প্রশ্ন করতে পারেন

১- পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার পাশাপাশি তিলাওয়াত শুদ্ধ আছে কী না জিজ্ঞেস করবেন৷ প্রতিদিন কতটুকু তিলাওয়াত করেন, সেটাও জানা উচিত৷

২- এ পর্যন্ত শরয়ী পর্দা মেনে চলার বিবরণ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা৷ নেকাব, হাতমোজা, পা-মোজা ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কী না৷ ইতোমধ্যে পর্দা পালনে ঘাটতি থাকলেও বিয়ের পর শতভাগ পর্দা মানতে তৈরি আছেন কী না৷

৩- মাহরাম নন-মাহরাম মেনে চলেন কী না৷ ভবিষ্যতে কীভাবে এসব মেন্টেন করে চলবেন?

৪- স্বামীর আনুগত্যের ব্যাপারে কতটুকু আন্তরিক৷ কারণ এই একটি ফরয অনেকগুলো ফরয আদায়ে সহায়ক হবে৷

৫- ক্যারিয়ার ভাবনা ও বাইরে চাকরি করার কোনো প্লান আছে কী না৷ এক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী সুস্পষ্ট বলে দেয়া৷

৬- যৌথ ফ্যামিলি বা একক ফ্যামিলি, কোনটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন৷ পৃথক ফ্যামিলি চয়েস করলে মন্দ ভাবা যাবে না। এটা একজন বধূর অধিকার। এ ক্ষেত্রে আপনার পরিকল্পনাও সংক্ষেপে বলতে পারেন।

৭- ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতায় নিজেকে মানিয়ে নেয়া, ধৈর্যধারণ করার মতো মনমানসিকতা ও প্রিপারেশন আছে কী না৷

উল্লেখ্য, সবগুলো সবার ক্ষেত্রে একসঙ্গে আলোচনা করা যাবে না৷ একজন নতুন পরিচিত মানুষ ভড়কে যেতে পারেন৷ ভয় ও আতঙ্কও সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে৷ তাই পরিস্থিতি বোঝে, পূর্ব জানাশোনার আলোকে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে হবু স্ত্রীর সাথে কথা বলা যায়৷ সবার সাথে সব বিষয় আলাপ করা যাবে না৷ ব্যক্তি বোঝে আলোচনার পয়েন্ট ঠিক করতে হবে৷

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *