Author: Mufti Ziaur Rahman

  • ৫ মিনিট পূর্বে মুআযযিন সাহেব আযান দেওয়ার কারণে সবাই ইফতার করে ফেলেছে

    প্রশ্ন: মুআযযিন সাহেব ভুলে ইফতারের ৫ মিনিট পূর্বে আযান দিয়ে ফেলেছেন। এলাকার সবাই আযান শুনে ইফতার করে ফেলেছে। এই রোযার বিধান কী?

    উত্তর: নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট পূর্বে ইফতার করার কারণে সবার রোযা ফাসিদ হয়ে যাবে। ঈদের পর সবাই একটি করে রোযা কাযা করবেন। যেহেতু ভুলবশত হয়েছে, তাই কাফফারা লাগবে না।

    কুরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-‍
    ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ
    অর্থ: তারপর রাতের আগমন পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর। (সূরা বাকারা: ১৮৭)

    আল-হেদায়া কিতাবে (১/১২৬) এসেছে-

    أو أفطر وهو يرى أن الشمس قد غربت فإذا هي لم تغرب ۔۔۔ و عليه القضاء
    অর্থ: … অথবা ইফতার করে ফেলেছে এই ধারণা করে যে, সূর্য অস্ত গিয়েছে, অথচ তখনও অস্ত যায় নি। তার উপর এই রোযার কাযা আবশ্যক।

    রদ্দুল মুহতারে এসেছে-

    تسحر أو أفطر يظن اليوم) الوقت الذي أكل فيه (ليلاٍ و) الحال أن (الفجر طالع و الشمس لم تغرب) ….. (قضی فقط). (رد المحتار: 4/ 436)
    উল্লেখ্য, ইফতার করা কিংবা সাহরি খাওয়া বন্ধ করা আযান হওয়া না হওয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। টাইম দেখে ইফতার করবেন, টাইম দেখে সাহরি খাওয়া বন্ধ করবেন।

  • বিয়ের পূর্বে কনে দেখার গুরুত্ব ও ইসলাম

    বিয়ের পূর্বে কনে দেখা

    মুফতি জিয়াউর রহমান

    বিয়ে করার ক্ষেত্রে কনে দেখা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ পরবর্তী দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি এখান থেকেই শুরু। তাই কনে দেখার আগে ঠিক করে নেবেন আপনি বিয়ে কেন করছেন? সাময়িক সুখ লাভের জন্য? নাকি বিয়ের মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী কোনো প্ল্যান আছে?

    অবশ্যই মুমিন প্ল্যান ছাড়া কোনো কাজ করতে পারে না।

    প্ল্যান-১. বিয়ের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

    وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً.
    অর্থ: তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন৷ (সুরা রুম: ২১)

    প্ল্যান-২. বিয়ের মাধ্যমে চোখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজত। চরিত্রের হেফাজত। জীবন ও যৌবনকে পবিত্র রাখা।

    আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

    يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ

    অর্থ: হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-৪৭৭৮, সহীহ মুসলিম হাদীস নং-১৪০)

    প্ল্যান-৩. অধিক সন্তানের মাধ্যমে নবীজির খাঁটি উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি।
    রাসূলুল্লাহ ﷺ অধিক সন্তান দানকারী নারীদের বিয়ে করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন৷ এটাই প্রমাণ করে শরীয়তে অধিক সন্তান হওয়া কাম্য৷ কম সন্তান হওয়া কাম্য নয়৷ যদি সবকিছুর এখতিয়ার আল্লাহ তাআলার হাতে৷

    নাবী কারীম ﷺ বলেছেন-

    تزوَّجوا الوَدودَ الولُودَ فإنِّي مُكاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ.

    অর্থ: তোমরা এমন মেয়েদেরকে বিবাহ কর, যারা পতিপরায়ন ও অধিক সন্তান প্রসবকারীনী হয়৷ (অর্থাৎ এমন বংশ বা পরিবারের মেয়ে বিবাহ করো, যে বংশ বা ররিবারের মেয়েরা বেশী সন্তান ধারণ করে) কেননা, কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের দ্বারা উম্মতের আধিক্য নিয়ে অন্য উম্মতদের মাঝে গর্ব করবো৷ (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং-১২৬৩৪)

    হাদিসে কনে দেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে৷ রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

    إِذَا خَطَبَ أَحَدُکُمْ الْمَرْأَةَ فَإِنْ اسْتَطَاعَ أَنْ يَنْظُرَ إِلَی مَا يَدْعُوهُ إِلَی نِکَاحِهَا فَلْيَفْعَلْ.
    অর্থ: তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোনো নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দিবে, তখন তার কোনো সৌন্দর্যের দিকে তাকানো সম্ভব হলে, তা যেন দেখে নেয়৷ (মুসনাদে আহমদ: ১৪৬২৬, আবু দাউদ: ২০৮২)

    আনাস রাযি. বলেন-
    أَنَّ الْمُغِيرَةَ بْنَ شُعْبَةَ أَرَادَ أَنْ يَتَزَوَّجَ امْرَأَةً فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صلی الله عليه وآله وسلم اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا فَإِنَّهُ أَحْرَی أَنْ يُؤْدَمَ بَيْنَکُمَا فَفَعَلَ فَتَزَوَّجَهَا فَذَکَرَ مِنْ مُوَافَقَتِهَا .
    মুগীরা ইবনে শুবা রাযি. এক নারীকে বিয়ে করার ইচ্ছা করলেন৷ রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বললেন, যাও গিয়ে দেখো৷ কেননা আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে প্রীতির সৃষ্টি হবে৷ তিনি তা-ই করলেন৷ এরপর তিনি ওই নারীকে শাদি করে নিলেন৷ পরে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে তাদের সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্কের আলোচনা করলেন৷ (মুসনাদে আহমদ: ১৮১৭৯, নাসাঈ: ১৮৬৫)

    কনে দেখার ক্ষেত্রে বর নিজে না গিয়ে পরিবারের নারীদের পাঠিয়েও দেখার কাজ সম্পন্ন করতে পারে৷ নারীদের থেকে পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া গেলে পরে বর গিয়ে দেখবে৷

    وإذا لم یمکنه النظر استحب أن یبعث امرأة یثق بہا تنظر إلیہا وتستخبرہ۔ (فتح الملہم ۳/۴۷۶رشیدیة
    অর্থ: বরের জন্য কনে দেখা যদি সম্ভব না হয়, তখন মুস্তাহাব হলো, এমন নারীকে পাঠানো, যার দেখা ও সংবাদের উপর বর নির্ভর করতে পারে৷ (ফতহুল মুলহিম: ৩/৪৭৬)

    কনে দেখার ক্ষেত্রে এখানে কয়েকটি বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার-

    এক. কনে দেখা হবে সর্বশেষ প্রক্রিয়া৷ এর আগে জানাশোনার অন্যান্য বিষয় ও প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে হবে৷ আমাদের সমাজে প্রথমেই কনে দেখা হয়৷ এমনটা ঠিক নয়৷ পরবর্তীতে কোনো কারণে বিয়ে না হলে কনে ও তার পরিবারের জন্য লজ্জা ও বিব্রত হওয়ার কারণ ঘটে৷

    দুই. কনে দেখার ক্ষেত্রে যত কম আনুষ্ঠানিকতা হবে, ততই ভালো৷ বরং উত্তম তো হলো, পাত্র যে কোনো উপায়ে চুপিসারে কনেকে দেখে নিবে৷ কিংবা পারিবারিকভাবে গিয়ে দেখে নেবে৷ তবে এই দেখা হতে হবে বিয়ের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া হিসেবে৷

    তিন. যারা অনেক জায়গা দেখেছেন, কিন্তু উপযুক্ততার নিজের বানানো কতিপয় মাপকাঠি নিয়ে দেখেছেন৷ আল্লাহর ওয়াস্তে শরীয়ত কৃত মাপকাঠি ছাড়া বংশ, আঞ্চলিকতা, এরিয়া, সীমানায় ঘুরপাক খেয়ে সময় নষ্ট করবেন না৷ উপযুক্ত জায়গাগুলো হারাবেন না৷

    চার. বিয়েতে ‘কুফু’ বা পরস্পরে সমতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ কিন্তু আমাদের নিজেদের তৈরি বা বৃটিশের দেয়া বংশবৈষম্যকে আমরা কুফু মেনে শরীয়তের নামে জাহিলিয়াতের চর্চা করে যাচ্ছি৷ যার কারণে বিয়েটাকে কঠিন করে দিয়েছি৷ কিন্তু ইসলামে কুফু বা সমতার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- দ্বীন৷

    ছেলে এবং মেয়ের দ্বীনদারিতায় সমতা রক্ষা হলেই কুফুর প্রধান শর্ত পাওয়া গেলো৷ কিন্তু আমরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে ফেলেছি৷ তবে হ্যাঁ কুফু বা সমতার অন্যান্য পারিপার্শ্বিক বিষয়ও একান্ত প্রয়োজনে খেয়াল করা যায়৷ এগুলোও গুরুত্বহীন নয়৷ তবে মনে রাখতে হবে এগুলো কুফুর মূল শর্তের অন্তর্ভুক্ত নয়৷

    কনে দেখার সময় যে কয়টি প্রশ্ন করতে পারেন

    ১- পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার পাশাপাশি তিলাওয়াত শুদ্ধ আছে কী না জিজ্ঞেস করবেন৷ প্রতিদিন কতটুকু তিলাওয়াত করেন, সেটাও জানা উচিত৷

    ২- এ পর্যন্ত শরয়ী পর্দা মেনে চলার বিবরণ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা৷ নেকাব, হাতমোজা, পা-মোজা ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কী না৷ ইতোমধ্যে পর্দা পালনে ঘাটতি থাকলেও বিয়ের পর শতভাগ পর্দা মানতে তৈরি আছেন কী না৷

    ৩- মাহরাম নন-মাহরাম মেনে চলেন কী না৷ ভবিষ্যতে কীভাবে এসব মেন্টেন করে চলবেন?

    ৪- স্বামীর আনুগত্যের ব্যাপারে কতটুকু আন্তরিক৷ কারণ এই একটি ফরয অনেকগুলো ফরয আদায়ে সহায়ক হবে৷

    ৫- ক্যারিয়ার ভাবনা ও বাইরে চাকরি করার কোনো প্লান আছে কী না৷ এক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী সুস্পষ্ট বলে দেয়া৷

    ৬- যৌথ ফ্যামিলি বা একক ফ্যামিলি, কোনটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন৷ পৃথক ফ্যামিলি চয়েস করলে মন্দ ভাবা যাবে না। এটা একজন বধূর অধিকার। এ ক্ষেত্রে আপনার পরিকল্পনাও সংক্ষেপে বলতে পারেন।

    ৭- ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতায় নিজেকে মানিয়ে নেয়া, ধৈর্যধারণ করার মতো মনমানসিকতা ও প্রিপারেশন আছে কী না৷

    উল্লেখ্য, সবগুলো সবার ক্ষেত্রে একসঙ্গে আলোচনা করা যাবে না৷ একজন নতুন পরিচিত মানুষ ভড়কে যেতে পারেন৷ ভয় ও আতঙ্কও সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে৷ তাই পরিস্থিতি বোঝে, পূর্ব জানাশোনার আলোকে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে হবু স্ত্রীর সাথে কথা বলা যায়৷ সবার সাথে সব বিষয় আলাপ করা যাবে না৷ ব্যক্তি বোঝে আলোচনার পয়েন্ট ঠিক করতে হবে৷

  • ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পূজোয় অংশগ্রহণ, শুভেচ্ছা বিনিময় ও প্রসাদ খাওয়ার বিধান

    ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পূজোয় অংশগ্রহণ, শুভেচ্ছা বিনিময় ও প্রসাদ খাওয়ার বিধান

    ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পূজোয় অংশগ্রহণ, শুভেচ্ছা বিনিময় ও প্রসাদ খাওয়ার বিধান

    মুফতি জিয়াউর রহমান

    হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের পূজা-অর্চনায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সঙ্গে শিরক করে, এটা তারা জেনেবুঝেই করে৷ এবং এটাকে তারা দোষের কিছু মনে করে না৷ বরং পূণ্যের কাজ মনে করে৷ দোষকে দোষ মনে না করা, অন্যায়কে অন্যায় মনে না করা খুবই মারাত্মক এবং দুর্ভাগ্যজনক বিষয়৷ হেদায়াতের পথে বড় অন্তরায়৷

    আর আমরা তাদের এসব শিরকি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করি৷ কারণ শিরককে আমরা মহা অন্যায় মনে করি৷ কেননা আল্লাহ তাআলা শিরককে “মহা অন্যায়” বলেছেন৷ “বড় জুলুম” বলেছেন৷ ইরশাদ হচ্ছে-

    ﺇِﻥَّ ﭐﻟﺸِّﺮۡﻙَ ﻟَﻈُﻠۡﻢٌ ﻋَﻈِﻴﻢٞ ‏
    অর্থ: নিশ্চয়ই শিরক হলো মহা অন্যায়। (সূরা লুকমান, আয়াত : ১৩)

    শিরকের ভয়াবহ পরিণতি হচ্ছে-

    اِنَّهٗ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَیْهِ الْجَنَّةَ وَ مَاْوٰهُ النَّارُ وَ مَا لِلظّٰلِمِیْنَ مِنْ اَنْصَار.

    অর্থ: নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়িদা: ৭২)

    ইসলামে প্রবেশ করতে হবে পরিপূর্ণরূপে৷ আর পরিপূর্ণ ইসলামের প্রধান শর্ত হচ্ছে, সকল শিরকি-কুফুরি বিশ্বাস ও কাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কচ্ছেদ করা৷ সবকিছু বর্জন করা৷ কুফর-শিরককে অন্তর থেকে ঘৃণা করা৷ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

    یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِی السِّلْمِ كَآفَّةً  وَّ لَا تَتَّبِعُوْا خُطُوٰتِ الشَّیْطٰنِ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوّ مُّبِیْنٌ.

    অর্থ: হে মুমিনগণ! ইসলামে সম্পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা: ২০৮)

    আনাস বিন মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

    ثَلَاثٌ مَن كُنَّ فيه وجَدَ حَلَاوَةَ الإيمَانِ: أنْ يَكونَ اللَّهُ ورَسولُهُ أحَبَّ إلَيْهِ ممَّا سِوَاهُمَا، وأَنْ يُحِبَّ المَرْءَ لا يُحِبُّهُ إلَّا لِلَّهِ، وأَنْ يَكْرَهَ أنْ يَعُودَ في الكُفْرِ كما يَكْرَهُ أنْ يُقْذَفَ في النَّارِ.

    অর্থ: তিনটি জিনিস যার মধ্যে রয়েছে, সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ অনুভব করতে পেরেছে। এক. যার কাছে আল্লাহ ও তার রাসূল ﷺ সবচেয়ে বেশী প্রিয়। দুই. কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই অন্যকে ভালোবাসে। তিন. যাকে আল্লাহ কুফর থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সে পুনরায় কুফরের দিকে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করে যেমন অপছন্দ করে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে। (বুখারী হাদীস নং-১৬, মুসলিম হাদীস নং-৪৩)

    তাই পূজা বা যে কোনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উৎসবে অংশগ্রহণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷ পূজায় যাওয়া নিজের ঈমানের জন্য খুবই ক্ষতিকারক৷ ঝুঁকিপূর্ণ৷ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-

    وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آَيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ.

    অর্থ: এবং ইতোপূর্বে তিনি কুরআনে তোমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহ্‌র আয়াতকে অস্বীকার করা হচ্ছে কিংবা বিদ্রুপ করা হচ্ছে, তাদের সাথে তোমরা বসো না, যতক্ষণ না তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের মত বলে গণ্য হবে। (সূরা নিসা আয়াত: ১৪০)

    তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনে এই আয়াতের তাফসীরী আলোচনায় বলা হয়েছে, কুফুরির প্রতি মৌন সম্মতিও কুফরি!

    আলোচ্য আয়াতের শেষে ইরশাদ হয়েছে-
    إنكم إذامثلهم
    অর্থাৎ, এমন মজলিস যেখানে আল্লাহ তাআলার আয়াত ও আহকামকে অস্বীকার, বিদ্রূপ বা বিকৃত করা হয়, সেখানে হৃষ্টচিত্তে উপবেশন করলে তোমরাও তাদের সমতুল্য ও তাদের গোনাহের অংশীদার হবে৷ অর্থাৎ, আল্লাহ না করুন, তোমরা যদি তাদের কুফুরি কথাবার্তা মনে-প্রাণে পছন্দ কর, তাহলে তোমরাও কাফের হয়ে যাবে৷ কেননা কুফরিকে পছন্দ করাও কুফুরি৷ (মাআরেফুল কুরআন, উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)

    আত্মপরিচয়ের সংকটে মুসলিম সমাজ

    আত্মপরিচয়ের সংকটে আমাদের মুসলিম সমাজ৷ এরা নিজেদের ঈমানের গুরুত্ব বুঝে না৷ নিজের ঈমানের কী দাম, তা উপলব্ধি করতে পারে না৷ ঈমানের দাবি কী, সেটাও জানে না৷ উত্তরাধিকারসূত্রে ঈমান পেয়েছে৷ ত্যাগ, কুরবানী, রক্ত ঝরানো কিছুই লাগে নি৷

    যারা কুরবানী দিয়ে ঈমান এনেছে, হেদায়াতের পথে এসেছে, দ্বীন পেয়েছে, তাদের জিজ্ঞেস করুন ঈমানের কী দাম!

    যত নবী-রাসূল পৃথিবীতে এসেছেন, সবার তো একই দাওয়াত ছিলো- ঈমান বিল্লাহ ও কুফর বিত-তাগুত৷ অর্থাৎ তাওহিদ গ্রহণ ও শিরক বর্জন৷

    আল্লাহ তাআলা বলেন-

    وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّة رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَاجۡتَنِبُوا الطَّاغُوۡتَ
    অর্থ: নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক উম্মতের ভেতর কোনও না কোনও রাসূল পাঠিয়েছি এই পথনির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে (শয়তান ও মূর্তিপূজা) পরিহার কর। (সূরা নাহল: ৩৬)

    শিরকের আয়োজনে অংশগ্রহণ করা

    হাদীসে এসেছে-
    مَنْ كَثّرَ سَوَادَ قَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ وَمَنْ رَضِيَ عَمَلَ قَوْمٍ كَانَ شَرِيكًا لِمَنْ عَمِلَهُ.
    অর্থ: যে ব্যক্তি কোনো কওমের দল ভারী করবে সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে। আর যে কোনো সম্প্রদায়ের কাজের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে সে সে কাজের অংশীদার বলে ধতর্ব্য হবে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা: ৪/৩১৫, নাসবুর রায়াহ, ৪/৩৪৬-৩৪৭, ফাতহুল বারী হাদীস নং-৭০৮৫)

    উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. বলেন-

    ﺭﻭﻯ ﺍﻟﺒﻴﻬﻘﻲ ﺑﺈﺳﻨﺎﺩ ﺻﺤﻴﺢ ﻋﻦ ﻋﻤﺮ ﺑﻦ ﺍﻟﺨﻄﺎﺏ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﺃﻧﻪ ﻗﺎﻝ: ﻻ ﺗﺪﺧﻠﻮﺍ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻤﺸﺮﻛﻴﻦ ﻓﻲ ﻛﻨﺎﺋﺴﻬﻢ ﻳﻮﻡ ﻋﻴﺪﻫﻢ ﻓﺈﻥ ﺍﻟﺴﺨﻄﺔ ﺗﻨﺰﻝ ﻋﻠﻴﻬﻢ.
    অর্থ: খলীফাতুল মুসলিমীন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন: তোমরা মুশরিকদের উৎসবের সময় তাদের উপাসনালয়ে যেও না। কেননা, সেখানে তাদের উপর আল্লাহর গযব বর্ষিত হয়।’
    (আস-সুনানুল কুবরা, বায়হাকী হাদীস নং-১৮২৮৮)

    উপরের আলোচনার সারনির্যাস হলো, অমুসলিমদের ধর্মীয় উপাসনায় অংশগ্রহণ করার বিধান ব্যাখ্যা সাপেক্ষে আরোপিত হবে৷ যদি সে এসব শিরকি অনুষ্ঠান মনেপ্রাণে উপভোগ করে ও তা ভালোর স্বীকৃতি দেয়, তাহলে তা কুফরী হবে৷ ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ আর যদি এমনিতেই সেখানে যায় কিন্তু এসবের প্রতি পজিটিভ বিশ্বাস না রাখে, তাহলে কবীরা গোনাহ হবে৷ হারাম হবে৷ (ফাতাওয়া মাহমূদিয়া: ২৯/৩৪৫, কিতাবুন নাওয়াযিল: ১৬/৩৩৮)

    হাদীস শরীফে বেশ কিছু ক্ষেত্রে

    خالفوا المشركين خالفوا اليهود

    (ইয়াহুদীদের সঙ্গে ভিন্নতা অবলম্বন করো, মুশরিকদের কাজকর্মের সাথে ভিন্নতা অবলম্বন কর) বাক্যটি ধ্বনিত হয়েছে। নামাযে আহ্বনের ক্ষেত্রে ইয়াহুদী, নাসারাদের ঘণ্টা বাজানো ও সিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার প্রথা গ্রহণ না করা, অভিভাদনের ক্ষেত্রে হাত উঠানোর বিকল্প হিসেবে সালামকে গ্রহণ করা, সপ্তাহের পবিত্র দিন হিসেবে শনি, রবির পরিবর্তে জুমা বারকে গ্রহণসহ এ ধরনের বহু ক্ষেত্র বিদ্যমান যেখানে ইসলামের কার্যকলাপকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে পৃথক করা হয়েছে।

    হিন্দুরা আমাদের কুরবানীকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে৷ তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমরা গরু দিয়ে কুরবানী করি আর তাদের বিশ্বাস মতে গরু তাদের মা৷ মুসলমানরা তাদের লক্ষ লক্ষ ‘মা’কে কুরবানীতে হত্যা করে৷ এ জন্য তারা আমাদের কুরবানীর প্রতি চরমভাবে বিদ্বেষ পোষণ করে৷

    পূজার দিন তারা কী করে? আমাদের মহান রবের সঙ্গে শিরক করে৷ তাঁর তাওহিদের শিক্ষাকে অবমাননা করে৷ এটি তো মুসলমানদের জন্য আরো তীব্রভাবে আত্মসম্মানবোধে লাগার কথা যে, মহান প্রতিপালক ও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সঙ্গে সবচে বড় বেআদবি অবমাননা করা হচ্ছে৷ সেই পূজায় আমি কীভেবে যাই?

    তাদের মেলা থেকে খরিদকৃত পণ্যের বিধান

    বিধর্মীদের মেলায় অংশগ্রহণ কখনোই জায়েয নয়, হারাম৷ গান-বাজনাসহ অনেকগুলো সম্মিলিত পাপ সেখানে সংঘটিত হয়৷ তবে মেলা থেকে খরীদকৃত পণ্য যদি হালাল হয়, তাহলে সেটা খাওয়া কিংবা ব্যবহার জায়েয আছে৷ তবে

    পবিত্র কুরআনে সুরা ফুরকানের আয়াত-

    وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا

    অর্থাৎ তারা মিথ্যা ও বাতিল মজলিসে যোগদান করে না৷ (সুরা আল-ফুরকান ৭২)
    এই আয়াতের তাফসীরে ইবনে আব্বাস রা, বলেন, এর অর্থ মুশরিকদের ঈদ, মেলা ইত্যাদি৷ হযরত মুজাহিদ রাহ, মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়া রাহ, বলেন, এখানে গান-বাজনার মাহফিল বুঝানো হয়েছে৷ (মাআরেফুল কুরআন)

    যেহেতু মুশরিকদের মেলায় দেদারসে গান-বাজনা হয়, তাই উপরোক্ত তাফসীরের মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্যতা নেই৷ বিধর্মীদের মেলা কিংবা ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ কখনোই জায়েয নয়৷

    রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন,

    من تشبه بقوم فهو منهم

    ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভ‚ক্ত বলে গণ্য হবে।’ Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৩১

    অন্য একটি বর্ণনায় খলীফা হযরত উমর রাযি. বলেছেন-
    اجتنبوا أعداء الله في عيدهم
    তোমরা আল্লাহর দুশমনদের উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাক। (আসসুনানুল কুবরা:১৮৮৬২)

    অন্য বর্ণনায় তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেছেন ‘কারণ এক্ষেত্রে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাযিল হয়ে থাকে।’

    আরেকটি বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেছেন

    من بنى ببلاد الأعاجم وصنع نيروزهم ومهرجانهم وتشبه بهم حتى يموت وهو كذلك، حشر معهم يوم القيامة.

    অর্থাৎ যারা বিধর্মীদের মত উৎসব করবে, কিয়ামত দিবসে তাদের হাশর ঐ লোকদের সাথেই হবে। (আসসুনানুল কুবরা: ১৫৫৬৩)

    দেবতার নাম উৎসর্গকৃত সব রকমের খাবার হারাম

    দেব-দেবি, মূর্তিসহ এক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ছাড়া যে কোনো কিছুর নামে উৎসর্গকৃত খাবার চাই তা জীবজন্তুর গোশত হোক বা মিষ্টান্ন দ্রব্য ও প্রসাদ হোক, হারাম৷

    সূরাহ বাকারার ১৭৩ নং আয়াতে আছে-
    إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنزِيرِ وَمَآ أُهِلَّ بِهِۦ لِغَيْرِ اللَّهِ ۖ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَآ إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

    অর্থ: তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন, মৃত জীব, রক্ত, শুকর মাংস এবং সেসব জীব-জন্তু যা আল্লাহ ব্যাতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু। (সুরা বাকারা-১৭৩)

    শুভেচ্ছা জানানো

    পূজা, বড়দিন বা যে কোনো অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো বৈধ নয়৷ শুভেচ্ছা মানে শুভ ইচ্ছা পোষণ করা৷ কল্যাণ কামনা করা৷ শিরকি কর্মকাণ্ডে কল্যাণ কামনা করা কোনো তাওহিদবাদী মুসলমানের জন্য জায়েয হওয়ার প্রশ্নই আসে না৷

    اِنۡ تَکۡفُرُوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ غَنِیٌّ عَنۡکُمۡ ۟ وَلَا یَرۡضٰی لِعِبَادِہِ الۡکُفۡرَ 
    অর্থ: তোমরা কুফর অবলম্বন করলে নিশ্চিত জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি নিজ বান্দাদের জন্য কুফর পছন্দ করেন না। (যুমার:৭)

    অথচ আমরা শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের কুফরকে পছন্দ করছি৷ নাউযুবিল্লাহ!

    ধর্ম যার যার উৎসবও তার, সর্বজনীন নয়

    আল্লাহ তাআলার কাছে ইসলামই একমাত্র মনোনীত ও পূর্ণাঙ্গ দীন৷
    إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ

    নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন। (সূরা আলে ইমরান: ১৯)

    আল্লাহ তা‘আলা অপর আয়াতে বলেন:
    وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
    যে ব্যক্তি ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন দীন (ধর্ম) তালাশ করবে কখনো তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা আলে ইমরান: ৮৫)।

    পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
    الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
    আজ আমি তোমাদের জন্য আমার দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামতকে তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন {ধর্ম} মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা: ৩)

    হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. 
    إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
    এই আয়াতের অধিনে লেখেন, এই আয়াতে নাস্তিক্য চিন্তাধারার মূলোৎপাটন করা হয়েছে। যাতে উদারতার নামে কুফর ও ইসলামকে এক করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং একথা প্রচার করা হচ্ছে যে, ভালো কাজ করলে ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী হলে যে কোন ধর্মাবলম্বীই মুক্তি পাবে- সে ইহুদী, খ্রিস্টান অথবা মূর্তিপূজারী যেই ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন। শর্ত হল ভালো কাজ ও উত্তম চরিত্রের পাবন্দী থাকতে হবে।

    এটা মূলত ইসলামী নীতিমালাকে মূলৎপাটন করারই নামান্তর। ইসলামের উৎসব মুসলমানদের জন্যই নির্দিষ্ট৷ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব সেসব ধর্মাবলম্বীদের জন্যই নির্দিষ্ট৷ যে কোনো ধর্মীয় উৎসব সর্বজনীন হতে পারে না৷

  • রোযার কাযা-কাফফারার বিধান

    প্রশ্ন: আমি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে কিছু রোযা রাখি নি। আমার উপর কাযা-কাফফারার বিধান কী?

    بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله.

    উত্তর: প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরপরই রামাযানের রোযা ফরয হয়ে যায়৷ তাই বালেগ হওয়ার পর থেকেই রোযা রাখা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয৷ ইচ্ছাকৃত রোযা ছাড়া খুবই মারাত্মক গোনাহ৷

    হাদীস শরীফে এসেছে-

    مَنْ أَفْطَرَ يَوْمًا مِنْ رَمَضَانَ مِنْ غَيْرِ رُخْصَةٍ وَلَا مَرَضٍ، لَمْ يَقْضِ عَنْهُ صَوْمُ الدّهْرِ كُلِّهِ وَإِنْ صَامَهُ.

    অর্থ: যে ব্যক্তি কোনো ওযর বা অসুস্থতা ব্যতিরেকে রমযানের একটি রোযা পরিত্যাগ করবে সে যদি ঐ রোযার পরিবর্তে আজীবন রোযা রাখে তবুও  ঐ এক রোযার ক্ষতিপূরণ হবে না। (তিরমিযী, হাদীস নং-৭২৩)

    প্রশ্নে বর্ণিত বিবরণ পড়ে বোঝা যাচ্ছে, আপনি মূল থেকেই কিছুদিন রোযা রাখেন নি৷ তাই যতদিন আপনি রোযা রাখেন নি, ততদিনের কাযা আদায় করতে হবে৷ কাফফারা নয়৷
    أو أصبح غير ناو للصوم فأكل عمداً
    অর্থ: …অথবা রোযার নিয়ত ছাড়াই ভোরে উপনীত হয়েছে, অর্থাৎ রোযা ছাড়াই দিন শুরু করেছে৷ তারপর ইচ্ছাকৃত খেয়েছে, (তখন রোযার শুধু কাযা ওয়াজিব হবে, কাফফারা নয়)৷ (রদ্দুল মুহতার: ২/৪০৩)

    তবে যদি রামাযানে রোযা রাখার পর ইচ্ছাকৃতভাবে আপনি রোযা ভেঙ্গে থাকেন, তাহলে কাযা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হবে৷

    واللہ تعالٰی أعلم بالصواب.

    উত্তর প্রদানে—মুফতি জিয়াউর রহমান

  • একটি বই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন

    বইটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন যখন লিখি (২২/৯/২০১৬) তখন বইটির মূল লেখক ও অনুবাদক উভয়ে জীবিত ছিলেন।

    আজকে (২৫/২/২৫ মঙ্গলবার বাদ যুহরো) যখন লেখাটি সাইটে পোস্ট করি, তখন এর অনুবাদক মুফতি রাইহান ভাইকে মাত্রই হারামের আঙ্গিনায় জানাযা পড়িয়ে মক্কার মাকবারায়ে শুহাদায় দাফন করা হলো। রাহিমাহুমাল্লাহু তাআলা রাহমাতান ওয়াসিআহ।

    বইয়ের নাম: নবীদের পুণ্যভূমিতে
    পাকিস্তানের মুফতিয়ে আযম আল্লামা রফী উসমানী রাহ. লিখিত এক আজীব সফরনামা৷ যা তিনি উর্দুন (জর্ডান), শাম (সিরিয়া) প্রভৃতি আরব দেশসমূহ ভ্রমণের বৃত্তান্ত নিয়ে লিখেছেন৷

    অনুবাদ: মুফতি খাইরান খাইরুল্লাহ রাহ.

    বইটি সম্পর্কে কী লিখব? যা লিখব, তা-ই কম হবে৷ মন চাচ্ছে পুরো বইয়ের সবগুলো বিষয়বস্তু এই পোস্টে সংক্ষেপ করে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করে দিই৷ কিন্তু তা সম্ভব হবে না৷ বইটির হকও আদায় হবে না৷ প্রথমেই উর্দুন সফরের ইতিবৃত্ত এসেছে৷ আসহাবে কাহফের গুহা পরিদর্শনের বিবরণ থেকে শিহরণ জাগানিয়া ভ্রমণবৃত্তান্তের শুরু৷ বইটি শুরু করেই বুঝতে পারলাম ভিতরে আরো অনেক কিছুই অপেক্ষা করছে আমার জন্যে৷ পাঠকমাত্রই চমকে যাওয়ার মতো কিছু৷ বাস্তবেও তাই পেলাম৷

    প্রতিটি পৃষ্ঠা ইসলামের সোনালি অতীতের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একেকটি ভাণ্ডার৷ জগদ্বিখ্যাত বিরাট বিরাট কিতাবের উদ্ধৃতি বইটিকে এতোই তথ্যসমৃদ্ধ করেছে যে, সাধারণত সফরনামা এমন হয় না৷ এ তো সফরনামা নয়, যেন ইলমের খাযানা৷ সফরনামা, কিন্তু প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাঠক পাবে ঈমানদীপ্ত ইতিহাসের বিরল স্বাদ৷ বইটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে নিজেকে আবিষ্কার করবে৷ সোনালি অতীতে হাতড়ে ফিরবে৷ নিজেকে সেই ইতিহাসের একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে অনুভূত হবে৷ আবার প্রতিটি জায়গায় পাঠক হযরতের সঙ্গও লাভ করবে৷

    এ যেন একসঙ্গে অতীত-বর্তমানের সমন্বয়৷ হযরত যেখানেই তাশরীফ নিয়েছেন, প্রতিটি এলাকার ভৌগলিক বিবরণ, পাহাড়, টিলা, নদী-নালা, গাছগাছালি, ঘর-বাড়ি, মসজিদ, মাজার ইত্যাদির নিখুঁত বিবরণ এসেছে, যেন পাঠক নিজ চক্ষে সবকিছু অবলোকন করছেন৷

    তাই বইটি পড়ুন। ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হবেন। জানার পরিধি বাড়বে, জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে।

    -জিয়াউর রহমান
    ২২/৯/২০১৬

  • কিভাবে কাটাবেন মাহে রমযান

    মুফতী তাকী উসমানী দা. বা.

    মাহে রমযান এক বিশাল নেয়ামত
    রমযান মাস আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এক মহান নেয়ামত। এ মাসের প্রকৃত মর্যাদা ও তাৎপর্য আমরা উপলব্ধি করব কিভাবে? আমরা তো দিন-রাত দুনিয়ার কাজে নিমগ্ন থাকি। সকাল থেকে সন্ধ্যা দুনিয়ার পিছনে ছুটি। বস্তুবাদের ফাঁদে আমরা আটকে গেছি। তাই আমরা কিভাবে বুঝব রমযান কী? আল্লাহ যাদেরকে অনুগ্রহ করেন, রমযানের নূর ও বরকত ধারা যারা বুঝেন, তারাই উপলব্ধি করেন এ মাসের প্রকৃত মর্যাদা। আপনি নিশ্চয় শুনে থাকবেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজবের চাঁদ দেখার পর থেকেই পাঠ করতেন এ দোয়া
    اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَان
    ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শা’বান মাস বরকতময় করুন। আমাদেরকে রমযান মাস পর্যন্ত পৌঁছে দিন। -মাজমাউয্যাওয়ায়েদ ২ : ১২৫
    একটু ভাবুন! স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই মাস আগ থেকেই এই রমযান মাসের অপেক্ষা করতেন। এ মাসটি ভাগ্যে জোটার জন্য আল্লাাহর দরবারে সবীনয়ে প্রার্থনা করতেন।

    বয়স বৃদ্ধির প্রার্থনা
    এক হাদীস থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি মাফিক চলার উদ্দেশ্যে নিজের দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া করা দূষণীয় নয়; বরং তা এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাই এ দোয়া করা উচিত, হে আল্লাাহ! আমার এ পরিমাণ বয়স বাড়িয়ে দাও যেন আমি তোমার মর্জি মাফিক আমল করতে পারি এবং তোমার দরবারে হাজিরা দেয়ার সময় যেন তোমার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি।
    কিন্তু আমাদের সমাজে কিছু লোক আছে, যারা এর উল্টোটা চায়। তারা বলে, হে আল্লাহ! এখন আমাকে এ দুনিয়া থেকে নিয়ে যাও। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জাতীয় দোয়া থেকে বারণ করেছেন। কারণ, দুনিয়ার দুরাবস্থা দেখে হয়ত তুমি মৃত্যু কামনা করছ, তোমার ধারণা মৃত্যু তোমাকে মুক্তি দেবে। কিন্তু একটি বারের জন্যও কি ভেবে দেখেছ- আখেরাতের জন্য কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ? এখন তোমার ইন্তেকাল হলে তোমার আখেরাত সুখময়ী হবে; এর নিশ্চয়তা আছে তোমার কাছে? কাজেই দোয়া মৃত্যুর নয়; বাঁচার জন্য করতে হবে। যতদিন আল্লাহ হায়াতে রেখেছেন ততদিন তাঁর মর্জি মাফিক চলার জন্য দোয়া করবে।

    জীবন সম্পর্কে রাসূল সা.-এর দোয়া
    এ জন্যই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন এভাবেÑ
    اَللَّهُمَّ أَحْيِنِيْ مَا كَانَتْ الحَيَاةُ خَيْرًا لِيْ وَ تَوَفَّنِيْ إِذَا كَانَتِ الوَفَاةُ خَيْرًا لِيْ (مسند أحمد ৩: ১০৪)
    হে আল্লাহ! যতদিন জীবন আমার জন্য কল্যাণময়, ততদিন আমাকে জীবিত রাখুন। আর যখন মৃত্যু হবে আমার জন্য মঙ্গলময় তখন আমাকে তুলে নাও। সুতরাং কল্যাণময় জীবন কামনা করতে কোনো অসুবিধা নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রমযান পর্যন্ত হায়াত কামানা থেকে তা প্রমাণিত হয়।

    রমযানের অপেক্ষা কেন?
    প্রশ্ন হলো, রমযানের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এতটা অপেক্ষা কেন? কেন এত ব্যকুলতা? এর কারণ হলো, আল্লাহ তাআলা রমযানকে নিজের মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আমাদের বুঝ স্থুল। তাই আমরা মনে করি রমযান মাসের বৈশিষ্ট হলো, এটা রোযার মাস। এতে কাজ হলো, কেবল রোযা রাখা এবং তারাবীহ নামায পড়া।
    বাস্তবতা হলো, এ মাসের তাৎপর্য এতটুকুতেই শেষ নয়। বরং রোযা, তারাবীহসহ রমযান মাসের যাবতীয় ইবাদত আরেকটি বিশাল বস্তুর প্রতীক। তাহলো, আল্লাহ তাআলা এ মাসটিকে নিজের মাস বলেছেন। যেসব লোক এগারো মাস পর্যন্ত ধন-সম্পদের নেশায় ডুবে ছিল, আমার থেকে দূরে সরে ছিল, দুনিয়ার ব্যস্ততায় এবং গাফিলতির অমানিশায় আচ্ছাদিত ছিল, আল্লাহ তাদেরকে এ মাসটি নৈকট্য লাভের জন্য দিয়েছেন।
    আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলছেন, উদ্দাম, স্বাধীনতা ও অপরিমিত আনন্দের মাঝে এগারোটি মাস কাটিয়েছ, নিজের খেয়াল-খুশি মতো চলছ, দুনিয়ার মোহে পরে আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেছ, এ মাসে আমার কাছে ফিরে আস, আমার নৈকট্য লাভ কর। কেননা এ মাস আমার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাস।

    মাহে রমযানে করণীয়
    মাহে রমযানে রোযা রাখা ও তারাবীহ নামায পড়ার মাঝেই দায়িত্ব ক্ষান্ত হয় না। এ মাসে জিম্মাদারী আরো অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা একটি মাসকে মানুষের পবিত্রতা ও আত্মশুদ্ধির জন্য নির্ধারণ করেছেন। যেমন, কোনো মেশিন বা গাড়ি কিছু দিন চলার পর তাতে কিছু ময়লা-আবর্জনা জমে। তাই তার সার্ভিসিং করাতে হয়। আমাদের জীবনের মেশিনও এগারো মাসের ব্যস্ততায় ময়লা-আবর্জনায় ভরে যায়। তাতে মরীচিকা পড়ে যায়। আল্লাহ তাআলা এ মাস দিয়েছেন, যাতে এর মাধ্যমে আমরা ময়লা-আবর্জনা দূর করতে পারি।

    মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য
    আল্লাহ তাআলা আমাকে ও আপনাকে কেন দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন তার উদ্দেশ্য সূরা যারিয়াতে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন
    وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
    অর্থাৎ আমি জিন ও মানুষকে শুধু এ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি, তারা আমার ইবাদত করবে। -সূরা যারিয়াত : ৫৬

    ফেরেশতা কি ইবাদতের জন্য যথেষ্ট নয়?
    কেউ যদি মনে করে, ইবাদত করার জন্য তো আল্লাহ তাআলা আগে থেকেই ফেরেশতা সৃষ্টি করে রেখেছেন। সুতরাং এ উদ্দেশ্যে মানুষ সৃষ্টির প্রয়োজন কি ছিল? এর উত্তর হলো, ফেরেশতাদেরকে ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করা হলেও, তাদের ইবাদত স্বভাবজাত। তাদেরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে এমনভাবে, তারা গুনাহ এবং আল্লাহর নাফরমানী করার ক্ষমতা রাখেন না। তারা সৃষ্টিগতভাবেই আল্লাহর ইবাদত করতে বাধ্য। তাই তাদের জন্য ইবাদত করা সহজ। পক্ষান্তরে মানুষকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন এমনভাবে, তার গুনাহ ও ইবাদত দু’টি করারই ক্ষমতা আছে। এরপর বলা হয়েছে, ইবাদত কর। তাই তাদের জন্য ইবাদত করা কঠিন।
    একইভাবে মানুষের মাঝে প্রবৃত্তি তাড়না আছে, আবেগ আছে, অনুভুতি আছে, লোভ-লালসা আছে, প্রয়োজন আছে, আরো আছে গুনাহর প্রতি আকর্ষণ। এরপর হুকুম করা হয়েছে গুনাহর এসব আবেদনকে উপেক্ষা করে, আবেগ ও আকর্ষণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং গুনাহর কামনা-বাসনা দলিত করে আল্লাহর ইবাদত কর।
    যাইহোক, বাহ্যত এ আয়াতের দাবি হলো পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো কাজ করবে না। খাবে না, পান করবে না, ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না, ঘুরা-ফেরা করবে না। সর্বক্ষণ ইবাদতে মশগুল থাকবে।
    অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনÑ
    إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ
    অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন। এর বিনিময়ে তাদেরকে জান্নাত দিবেন। -সূরা তাওবা : ১১১
    আল্লাহ জান ও মালের যেন এক বিশাল মূল্য দিয়েছেন। নিয়ম হলো, পণ্য ও মূল্যের মাঝে মিল থাকা। কিন্তু এ পণ্যের মধ্যে বাহ্যত সে মিল ও ভারসাম্যতা পরিলক্ষিত হয় না। কেননা আখেরাতের চিরস্থায়ী নিয়ামতের মোকাবেলায় মুসলমানের জান ও মালের কোনো তুলনাই হতে পারে না। এ যেন হিরার বিনিময়ে মাটির ঢিলা ক্রয়।

    জান্নাতে ভয়-ভীতি ও চিন্তা-ভাবনা থাকবে না
    কেননা জান্নাত এবং তার চিরস্থায়ী নিয়ামতসমূহ এমন, আজ পর্যন্ত কোনো অন্তরে তার ধারণা ও কল্পনা পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। সে সকল নিয়ামত থেকে শুধু একটি নিয়ামতের কথা চিন্তা করুন। যাকে কুরআনুল কারীম এভাবে বর্ণনা করেছেন,
    لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
    অর্থাৎ জান্নাতে যাওয়ার পর মানুষের কোনো ধরনের ভয়-ভীতি এবং চিন্তা-পেরেশানী থাকবে না। -সূরা ইউনূস : ৬২
    শুধু একটি নিয়ামতের ব্যাপারে চিন্তা করলেই দেখা যাবে সারা পৃথিবীর সমস্ত নিয়ামত তার সামনে তুচ্ছ। কেননা দুনিয়ার যে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাশ রয়েছে। তাতে ভয়-ভীতি বা চিন্তা-পেরেশানী আছেই। আপনি যত উন্নত খাবারই খান না কেন এবং সবচেয়ে সেরা বাহনে আরোহন করেন কিংবা সর্বোৎকৃষ্ট পোশাক পরেন না কেন তাতে নিজেকে ভয়-ভীতি ও চিন্তা-পেরেশানী মুক্ত রাখতে পারবেন না।
    এ দুনিয়ার নিয়মই হলো, এখানের সকল আনন্দের সহিত দুঃখ-বেদনার কোনো না কোনো কাটা জড়িয়েই আছে। জান্নাতে সকল নিয়ামতের উপস্থিতিতে আল্লাহ তাআলা এমন একটি নিয়ামত দান করবেন, না অতীতের কোনো বিষয়ের ভয় থাকবে, না ভবিষ্যতে কোনো আশংকা থাকবে।
    আল্লাহ আমাদের প্রাণ খরিদ করে এক বিশাল মূল্য নির্ধারণ করেছেন। অতএব আমাদের জান হলো বিক্রিত পণ্য। তার বিক্রয়চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। এখন আর সেটা আমার অধিকারে নেই। যিনি জান খরিদ করেছেন তার অধিকার ছিল তিনি সারা দিন তার সিজদায় পড়ে থাকার হুকুম করবেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্য আর কোনো কাজ করা যাবে না।

    আল্লাহ তাআলা কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন
    আমাদের জান খরিদকারী হলেন আরহামুর রাহিমীন। এত চড়া মূল্যে জান কিনেও তিনি তা আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার সকল কাজ-কর্ম করার অনুমতি দিয়েছেন। শুধুমাত্র অল্প কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। তা গ্রহণ করলেই চলবে। দিনে পাঁচবার তাঁর দরবারে হাজিরা দিতে হবে। নিজের সম্পদ যেভাবে ইচ্ছা খরচ করবে। বছরে কেবল শতকরা আড়াই পার্সেন্ট গরীবদেরকে দিতে হবে। কিছু হালাল ও হারামের ফিরিস্তি বলে দিয়েছেন, এসব জিনিস হারাম। এর থেকে বেঁচে থাকবে। আর এসব জিনিস হালাল, তা গ্রহণ করবে।

    সকল বৈধ কাজ ইবাদত
    এরপর আরো মজার বিষয় হলো, আল্লাহ তাআলা শুধু জান ফেরত দিয়ে আর শুধু প্রয়োজনীয় কাজকে বৈধ করে ক্ষান্ত করেননি; বরং তিনি বলে দিয়েছেন, তোমরা নিজ প্রয়োজনে যে কাজ-কর্ম করÑ তাও যদি আমার নাম নিয়ে কর, তা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হবে।
    খানা সকল মানুষই খায়। কিন্তু যদি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে এবং আলহামদুলিল্লাহ বলে শেষ করে। আর এই মনে করে খানা খায়, এটা আমার প্রতিপালকের নিয়ামত। তবে এই খানা গ্রহণ কেবল জায়িযই নয়; ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হবে। এতে সওয়াব লাভ হবে।
    এমনিভাবে সকলেই ঘুমায়। কিন্তু শয়নকালে যদি এ দোয়াপাঠ করে
    أللهم بإسمك أموتُ و أحيا
    অর্থাৎ হে আল্লাহ! তোমারই নামে আমার মরণ ও জাগরণ। জাগ্রত হওয়ার পর এতটুকু পড়ে নিবেÑ
    الحمد لله الذي أحيانا بعد ما أماتنا و إليه النشور
    শুধু এতটুকু কাজ করবে তাহলে ৬/৭ ঘন্টার ঘুম, যা ছিল নিজের জানের আরামের জন্য। শুরু ও শেষে আল্লাহর নাম আসার কারণে এই শয়নও ইবদতে পরিণত হয়ে যাবে।
    জীবিকা উপার্জনের জন্য বের হলে এ নিয়তে বের হবে, আমার পরিবার-পরিজনের আমার ওপর হক রয়েছে; তা পুর্ণ করার জন্য আল্লাহর বিধান মোতাবেক ব্যবসা বা চাকরী করব। তখন এ ব্যবসা এবং চাকরী কেবল জায়িযই হবে না; বরং শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হবে। ইরশাদ হচ্ছে
    التاجرُ الصدوقُ الأمينُ مع النبيينَ و الصِّدِّيقينَ و الشُّهَداءِ
    অর্থাৎ সত্যবাদী ও আমনতদার ব্যবসায়ীকে কেয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সাথে উঠানো হবে। -তিরমিযী ১/১৪৫
    মোটকথা, দুনিয়াতে এমন কোনো কাজ নেই যা সামান্য এদিক-সেদিক করে তা আমরা ইবাদতে পরিণত করতে পারব না।

    এক সাহাবীর প্রশ্ন
    একবার এক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, স্বামী-স্ত্রীর মিলনেও কি সওয়াব হয়? তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাতেও সওয়াব হয়। কেননা তোমরা জায়িয ও বৈধ পন্থায় জৈবিক চাহিদা পূরণ করছ। তাই তাতে সওয়াব পাবে। সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাাহ! আমরা তো নিজেদের প্রবৃত্তির চাহিদা পুরণ করছি! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যদি এই চাহিদা অবৈধ পন্থায় পূর্ণ করতে তবে কি গুনাহ হত না ? কিন্তু যখন আল্লাহ তাআলার অনুমোদিত পন্থায় তা পূর্ণ করলে তাই তাতে সওয়াব পাবে। -মুসনাদে আহমাদ ৫/৭
    এমনকি টয়লেটে যাওয়া এবং সেখান থেকে বের হওয়াও ইবাদতে গণ্য হতে পারে। টয়লেটে প্রবেশের পূর্বে হাদীসে বর্ণিত দোয়া।
    اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ
    صحيح مسلم ، كتاب الحيض ، باب ما يقول إذا أراد دخول الخلاء ১॥২৮৩
    আর বের হওয়ার সময় غفرانك বলবে। এতে করে যত সময় সেখানে কাটিয়েছে তাতে সওয়াব লাভ হবে। বলা যায়, এমন কোনো কাজ নেই যা আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য ইবাদত বানাননি। এটা আল্লাহ তাআলার কত বড় দয়া, মানুষ চাইলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিটা মুহূর্ত নিজের জন্য ইবাদতে পরিণত করতে পারে।

    ইবাদত দুই প্রকার
    তবে এখানে একটি বিষয় বুঝার আছে। যখন পানাহার, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বৈধ পন্থায় করলে তা ইবদতে পরিণত হতে পারে তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য আর নামাযের মধ্যে পার্থক্য কি? অনুরূপ যিকির ও খাওয়া-দাওয়ার মাঝে পার্থক্য কি রইল? দু’টিই তো ইবাদত। এ দু’টির মাঝে পার্থক্য খুব ভালোভাবে বুঝা দরকার। এই পার্থক্য না বুঝার কারণে অনেকে বিভ্রান্তির শিকার হন।
    ইবাদত দুই প্রকার। এক. [ফরৎবপঃ] ডাইরেক্ট বা সরাসরি ইবাদত। দুই. [রহ ফরৎবপঃ] ইনডাইরেক্ট বা পরোক্ষ ইবাদত।

    সরাসরি ইবাদত
    কিছু আমল এমন আছে যা সরাসরি ইবাদত। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, সদকা, কুরবানী, যিকির, তিলাওয়াত এসবই হলো সরাসরি ইবাদত। এগুলোর উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কিছু নয়। একারণেই কেউ যদি নামায পড়তে গিয়ে এ নিয়ত করে, আমি শারীরিক কসরত করছি, তবে তার নামাযই হবে না। কেননা এর উদ্দেশ্যই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।

    পরোক্ষ ইবাদত
    দ্বিতীয় হলো, ঐ সকল বিষয় যা সরাসরি ইবাদত নয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে সহীহ নিয়তের বরকতে তা ইবাদতে পরিণত করেন। আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দাদেরকে বলে দিয়েছেন, তোমরা পার্থিব কাজও যদি ভালো নিয়তে সীমারেখার ভেতর থেকে কর এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত মোতাবেক কর তবে তাতেও আমি সেই সওয়াব দান করব যা সরাসরি ইবাদতে দান করি।

    হালাল উপার্জন পরোক্ষ ইবাদত
    যেমন বলা হয়েছে, তুমি যদি স্ত্রী-সন্তানের হক আদায় করার উদ্দেশ্যে বৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জন কর। আর নিয়্যত কর, আমার উপর স্ত্রী-সন্তান এবং নিজের যে হক রয়েছে তা আদায় করার জন্য উপার্জন করছি। তাহলে এই উপর্জনকেও আল্লাহ তাআলা ইবাদতে পরিণত করবেন। যদিও আসলে এই উপর্জন ইবাদতের জন্য ছিল না। তাই এটা সরাসরি ইবাদত নয়। পরোক্ষ ইবাদত।

    সরাসরি ইবাদতের সওয়াব বেশি
    এটা স্পষ্ট, পরোক্ষ ইবাদতের তুলনায় সরাসরি ইবাদতের মর্যাদা বেশি। কেননা সরাসরি ইবাদতের বৈশিষ্ট্য হলো, তা আত্মিক উন্নতি এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের মাধ্যম হয়। পরোক্ষ ইবাদতের বিষয়টি ব্যতিক্রম। কেননা তাতে যদিও সওয়াব হয়, কিন্তু আত্মিকভাবে সেই উঁচু মাকাম লাভ হয় না, যা সরাসরি ইবাদতের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

    এক ডাক্তারের ঘটনা
    কিছুদিন পূর্বে এক মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার স্বামী একজন চিকিৎসক। তার একটা ক্লিনিক আছে। তিনি রোগী দেখেন। রোগী দেখার চাপে সময় মতো নামায পড়েন না। রাতে যখন বাসায় ফিরেন, তখন এক সঙ্গে তিন ওয়াক্ত নামায আদায় করে নেন। আমি তাকে বলি, বাসায় এসে তিন ওয়াক্ত এক সাথে পড়েন কেন? ক্লিনিকে সময় মতো পড়ে নিন, যাতে নামায কাযা না হয়। তিনি উত্তরে বলেন, ক্লিনিকে আমি রোগী দেখি। এটা তো সৃষ্টির সেবা। সৃষ্টির সেবা এক মহান ইবাদত। এর সম্পর্ক বান্দার হকের সাথে। আর নামায তো হলো, ব্যক্তিগত বিষয়। তাই আমি রোগী দেখাকে প্রাধান্য দিই। আর নামায বাসায় এসে পড়ে নেই। মহিলাটি আমাকে প্রশ্ন করল, আমি আমার স্বামীর এই যুক্তির কি উত্তর দেব?

    নামাযের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই
    মহিলার স্বামীর এ দৃষ্টিভঙ্গি ভুল। তার বিভ্রান্তির কারণ হলো, তিনি দুই প্রকারের ইবাদতের মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারেননি। কারণ, নামায হলো সরাসরি ইবাদত। এর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমরা যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মুখোমুখী থাকলেও নামায ছেড় না। যদিও সে অবস্থায় নামাযের পদ্ধতিতে কিছু শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু নামায মাফ করা হয়নি। নামাযের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেনÑ
    إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا (سورة النساء: ১০৩)
    অর্থ : নিশ্চয় নামায মুমিনদের উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।
    দেখুন, জিহাদের মতো মহান আমলের মধ্যেও নামায সময় মতো পড়তে বলা হয়েছে। নামাযের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া হয়নি।

    সৃষ্টির সেবা দ্বিতীয় পর্যায়ের ইবাদত
    এমনকি কেউ যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরে। কোনো কাজ-কর্ম করতে পারে না, তাকেও বলা হয়েছে, নামায অবশ্যই পড়তে হবে। এ অবস্থায়ও নামায মাফ হয় না। অবশ্য এতটুকু ছাড় দেয়া হয়েছে, দাড়িয়ে পড়তে না পারলে বসে পড়বে। বসে পড়তে না পারলে শুয়ে পড়বে। প্রয়োজনে ইশারা করে পড়বে। অযু করতে না পারলে তায়াম্মুম করবে। তবুও নামাায পড়তেই হবে। কেননা, এটা প্রত্যক্ষ ইবাদত। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ইবাদতের জন্যই। চিকিৎসক রোগী দেখেন। এটি সৃষ্টির সেবা। নিশ্চয় এটিও ইবাদত। তবে এটি সরাসরি ইবাদত নয়। বরং পরোক্ষ ইবাদত। তাই কোনো ক্ষেত্রে যদি এ দুই ধরনের ইবাদত সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেক্ষেত্রে প্রথম প্রকারের ইবাদতকেই প্রাধান্য দিতে হবে ।

    যেকোনে প্রয়োজনের তুলনায় নামায অধিক গুরুত্বপূর্ণ
    দেখুন, আপনি যখন ক্লিনিকে বসেন তখন কিন্তু আপনাকে অন্য প্রয়োজনেও উঠতে হয়। পেশাব-পায়খানার জন্য টয়লেটে যেতে হয়। তখন তো রোগী রেখেই আপনাকে যেতে হয়। ধরুন, ক্ষুধা লেগে গেল তাহলে কি আপনি রোগী রেখে খানা খাওয়ার জন্য বিরতী গ্রহণ করবেন না?
    এসব কাজের জন্য রোগী রেখে যেতে পারলে, নামাযের জন্য গেলে কি সমস্যা হয়ে যাবে? এতে সৃষ্টির সেবায় এমন কি ক্ষতি হবে? অথচ নামায অপরাপর মানবিক প্রয়োজনের তুলনায় বহু গুরুত্ববহ। মূলত ইবাদতের তাৎপর্য ও তার প্রকারদ্বয়ের মাঝে পার্থক্য না বুঝার কারণে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

    পরোক্ষ ইবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য
    পরোক্ষ ইবাদতের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাতে লিপ্ত হওয়ার পর সাধারণত মানুষ এতটা নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, তার ইবাদতের দিকটা চাপা পড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য এ জন্য শুরু করল যাতে নিজের অবশ্য পালনীয় হকগুলো আদায় করতে পারে।
    কিন্তু যখন বাজারে যায় এবং ব্যবসা শুরু করে তখন দেখতে পায় সেখানে বড় বড় ব্যবসায়ী বসে আছেন। টাকা দিয়ে টাকা হাসিলের অসংখ্য পথ খোলা রয়েছে। তখন এ টাকার খেলা দেখে চোখ উল্টে যায়। যার নূন্যতম প্রভাব এতটুকু হলেও পড়ে, যে উদ্দেশ্যে ব্যবসা শুরু করেছিল তা সাময়ীকভাবে হলেও ভুলে যায়। অথবা এর চেয়ে আগে বেড়ে যায়। সামান্য নাজায়িয কাজ হয়ে যায়। লোভ সৃষ্টি হয়, অমুক ব্যবসায়ী যেমন মাল কামাচ্ছে, আমিও কামাই। আর এ লোভের পেছনে পড়ে হালাল-হারামের তারতম্য হারিয়ে ফেলে। এটা ইনডাইরেক্ট ইবাদতে পরিণত হয়েছিল ঠিক কিন্তু এর প্রতি মনোযোগ এত বৃদ্ধি পেয়ে যায়, সে ব্যক্তি ব্যবসা সম্প্রসারে মশগুল হয়ে যায়। জামাত ছেড়ে দেয়। এক ওয়াক্তের নামায অন্য ওয়াক্তে পড়ে। তখন নামায আদায় করা হয় ঠিক, কিন্তু বোঝা মনে করে এবং আদবের প্রতি উদাসীনভাবে। ইনডাইরেক্ট ইবাদতের ফলাফল এই দাঁড়ায়, তার দ্বারা ডাইরেক্ট ইবাদতও পর্যদুস্ত হতে থাকে। মানুষের যে আধ্যাত্মিক উন্নতি হওয়ার কথা ছিল তাতে ভাটা পড়ে। তার আমল থেকে নূরানিয়াত এবং রূহানিয়াত শেষ হয়ে যায়। দুনিয়া কামানোর ধান্দা বেড়ে যায়। বস্তু নির্ভরতা বেড়ে যায়। [এবার মূল কথায় আসা যাক।]

    এক মাস তোমাকে দিচ্ছি
    আমরা এগারো মাস এভাবে কাটিয়ে দিয়েছি। আল্লাহর চেয়ে আমাদের মনের চাহিদা কে বেশি জানে? তিনি জানেন আমার বান্দা এ অবস্থায় এগারো মাস কাটিয়েছে, কখনো নামাযে ত্রুটি হয়েছে। কখনো অন্য ইবাদতে ত্রুটি হয়েছে। যার ফলে তার রূহানিয়াত কমে গিয়ে বস্তু প্রভাব বেড়ে গিয়েছে। আল্লাহ তাআলা এটা জেনে তার চিকিৎসা প্রদান করেছেন, এক মাস তোমাদেরকে দিলাম। তোমাদের রূহানিয়াতে যে ঘাটতি হয়েছে এবং বস্তু প্রভাব বেড়ে গিয়েছে, এ মাসে তার ক্ষতিপূরণ করে নাও। অন্তরে যে নাপাকী লেগেছে তা দূর করে নাও। অন্য ব্যস্ততা কমিয়ে সরাসরি ইবাদতে বেশি আত্মনিয়োগ কর। যখন এক মাস এভাবে কাটাবে তখন ইনশাআল্লাহ বাকি মাস কাটানো সহজ হয়ে যাবে। এ মাসে নিজের কাজ-কর্মের রুটিন তৈরি করে নিবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন।
    يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
    অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিলো, যাতে তোমরা বেঁচে যাও। -সূরা বাকারা : ১৮
    বুঝা গেল, পানাহার থেকে বিরত থাকা আসল উদ্দেশ্য নয়। বরং রোযা ফরযের আসল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন। এই মাস এ জন্য এসেছে যাতে বান্দা আসল জীবন তথা সরাসরি ইবাদতের দিকে ধাবিত হয়। এই মাস আসার আগে তার নিযামুল আওকাত তথা কাজের রুটিন এমনভাবে তৈরি করবে যাতে পার্থিব ব্যস্ততা কমিয়ে বেশির থেকে বেশি ইবাদতের প্রোগাম রাখবে। যাতে আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতির স্তর বেশি থেকে বেশি অতিক্রম করা যায়।

    রমাযানকে স্বাগত জানানোর সঠিক পন্থা
    আজকাল রমযানকে স্বাগত জানানোর নামে একটি পরিভাষা খুব প্রসিদ্ধি লাভ করছে। এটা আজ থেকে প্রায় বিশ বছর পূর্বে আমি মিসরে সর্বপ্রথম শুনেছিলাম। ঘটনাক্রমে শাবানের শেষের দিকে আমি মিসরে অবস্থান করছিলাম। সেখানে একটি বিশাল অনুষ্ঠান চলছিল। জানতে পারলাম প্রতি বছর ‘ইস্তেকবালে রমযান’ নামে এ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এ জনসভায় বক্তৃতা, তিলাওয়াত এবং না‘তে রাসূল আবৃতি হচ্ছিল।
    ‘ইস্তেকবালে রমযানের’ এ রসমি মাহফিল আল্লাহ জানেন, বিদ‘আতের আকৃতি ধারন না করে। কিন্তু ‘ইস্তিকবালে রমযানের’ আসল সুরত এই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হযরত সালমান ফারসী রা. বর্ণনা করেন, রমযানের একদিন আগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে একত্রিত করে খুতবা দিলেন। হে মুসলমানগণ! তোমাদের ওপর বড় মহান ও বরকতময় মাস ছায়াস্বরূপ আসছে। তার গুরুত্বের প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে বলেছেন। এ মাসে ফরযের প্রতি যতœবান হলে একটি ফরযের সওয়াব সত্তর ফরযের সমান হবে। আর নফলের সওয়াব ফরযের সমতুল্য হবে। [শুআবুল ঈমান]
    এমনভাবে ইস্তিকবাল করবে যাতে এই মাসকে সর্বাধিক আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করা যায়। তখনই এই ইস্তিকবাল হবে প্রশংসনীয়।

    দীনি মাদরাসাসমূহের বার্ষিক ছুটি
    দীর্ঘদিন থেকে দীনি মাদরাসাগুলোতে রমযান মাসে বাৎসরিক ছুটির রেওয়াজ চলে আসছে। পনের শা’বান থেকে পনের শাওয়াল পর্যন্ত বার্ষিক ছুটি থাকে। আমাদের বুযুর্গানেদীন এটা করেছেন যেন পুরো রমযান মাস ইবাদতে কাটানো যায়। এমনিতে মাদরাসাগুলোতে সারা বছরের সেসব কর্মসূচী পালিত হয়, তার সবই ইবাদত। যেমন- কুরআন শিক্ষা, হাদীস ও ফিকহ ইত্যাদি শিক্ষা সবই ইবাদত। তবে যেহেতু এগুলো রমযানের রোযার মতো সরাসরি ইবাদত নয়, তাই আমাদের বুযুর্গানেদীন অন্য মাসে ছুটির ব্যবস্থা না করে রমযান মাসকে বার্ষিক ছুটি হিসাবে নির্ধারণ করেছেন, যেন পুরো মাসটি সরাসরি ইবাদতের মধ্যে কাটানো যায়।
    তাই রমযান মাসে যাদের ছুটি কাটানো সম্ভব তারা এ মাসেই ছুটি কাটাবে। নতুবা অন্ততপক্ষে ব্যস্ততা কমিয়ে নিবে।

    মৌলভীর শয়তানও মৌলভী হয়
    আমার পিতা হযরত মুফতী শফী সাহেব রহ. বলতেন, ‘মৌলভীদের শয়তানও মৌলভী হয়’। অর্থাৎ শয়তান মওলানা সাহেবদিগকে ইলমের সুরতে ধোকা দেয়। শয়তান তাদেরকে বলে, এগারো মাস পার্থিব কাজে নিমগ্ন থাকার বিষয়টি তো পাবলিকের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। এটা তাদের ক্ষেত্রে প্রজোয্য যারা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরী-বাকরী এবং দুনিয়ার ধান্নায় লিপ্ত ছিল। তোমরা তো এগারো মাস দীনের কাজেই ব্যয় করেছ। দীন শিক্ষা দিয়েছ। তাবলীগ করেছ। কিতাব রচনা করেছ। এসবইতো দীনি খেদমত। অথচ এটি হলো শয়তানের প্রবঞ্চনা। কেননা এগারো মাস পর্যন্ত আলেমগণ যে ইবাদত করেছেন তাহলো পরোক্ষ ইবাদত। এখন রমযান মাস হলো সরাসরি ইবাদতের মাস। এ মাসকে সরাসরি ইবাদতে ব্যয় করা উচিত।
    একজন মুমিন বান্দার কর্তব্য হলো, রমযান আসার পূর্বেই একটি রুটিন তৈরি করে নেয়া। যেসব কাজ নগদ নয়, বরং পরবর্তীতে করার সুযোগ আছে, সেগুলোকে পিছিয়ে দিয়ে পুরো মাসটা কিভাবে ইবাদতের মধ্য দিয়ে কাটানো যায়, এ লক্ষ্যে তারাবীহ, তিলাওয়াত, যিক্রসহ বিভিন্ন আমালের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রুটিন করে নেয়া চাই।

    নিজ ব্যস্ততার হিসাব করবে
    আমার পিতা আরো বলতেন, রমযান আসার পূর্বে নিজ ব্যস্ততার খোঁজ-খবর নাও। দেখো! কোনো ব্যস্ততা এমন আছে কি না যা বাদ দেয়া যায়। তবে তা বাদ দিয়ে ডাইরেক্ট ইবাদতের আমলে মশগুল হও। আর ফরয নামায-রোযার বাইরে নফলের প্রতিও যতœবান হবে। কেননা অন্য সময় নফলের তেমন সুযোগ হয় না। তাই কমপক্ষে রমযানে এর প্রতি যতœবান হওয়া উচিত। তাহাজ্জুদ নামাযের ব্যাপারে যত্মবান হও। কেননা তাহাজ্জুদ এমন একটি নিয়ামত, এর মিষ্টতা ও স্বাদ তারাই অনুভব করে যারা এর মূল্যায়ন করে। হযরত শায়েখ আবদুল কাদির জিলানী রহ. এর স্বাদ উপলব্ধি করেছেন।

    অর্ধ রজনীর বাদশাহী
    হযরত শায়েখ আবদুল কাদির জিলানী রহ.-এর যুগে এক নওয়াব ছিলেন। তার ছোট্ট একটি রাজত্ব ছিল। নাম ছিল ‘নিম রোয’ [অর্ধ দিবস]। তিনি সীমাহীন ভক্তির ফলে নিজের সমগ্র রাজত্ব এবং জায়গীর হযরত শায়েখ রহ.-এর খেদমতে পেশ করেন। প্রতি উত্তরে হযরত শায়েখ রহ. তার নিকট একটি কবিতা লিখে পাঠান। যার মর্ম ছিলো, ‘যেদিন থেকে আল্লাহ আমাকে ‘নিমে শব’ [অর্ধ রজনী]-এর রাজত্ব দিয়েছেন, সেদিন থেকে আমি ‘নিম রোযের’ বাদশাহী এক পয়সার বিনিময়ও খরিদ করতে রাজি নই।’

    সুফিয়ান সাওরী রহ.-এর উক্তি
    হযরত সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, রাতের নামাযে আল্লাহ আমাদেরকে যে মজা ও স্বাদ দিয়েছেন যদি পৃথিবীর রাজা-বাদশাহ তা টের পেত তবে তারা আমাদের সাথে তরবারি নিয়ে মোকাবেলা করার জন্য চলে আসত।

    প্রিয়নবীর তাহাজ্জুদ
    রাসূল সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারাজীবন এই নামায পড়েছেন। রাতের পর রাত দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পা ফুলে গেছে। হযরত আয়েশা রা. এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার তো পূর্বাপর সব গুনাহ মাফ হয়ে গিয়েছে, তারপরও আপনি এত কষ্ট করছেন কেন? রাসূল সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেনÑ
    أَفَلَا أكُوْنَ عبدًا شكورًا
    অর্থাৎ আমি কি শোকরগুযার বান্দা হব না? -মুসলিম শরীফ
    অন্যান্য সময় এর সুযোগ হয়ে ওঠে না। অন্তত পক্ষে রমযানের রাতে এই সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। সাহরীর জন্য তো সকলেই ওঠে। চেষ্টা করবে কিছু আগে ওঠতে। তাহাজ্জুদের নিয়তে কয়েক রাকাত নামায আদায় করে নিবে। এই দৃঢ়সংকল্প করে নিবে, গোটা রমযান ইশরাক, চাশ্ত এবং অন্যান্য নফল আমল ছাড়ব না।

    বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করবে
    দ্বিতীয় বিষয় হলো, রমযান মাসের সাথে কুরআনের এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ কুরআন অবতরণের জন্য এই মাসকে নির্বাচন করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিবরীল আ.-এর সহিত কুরআনুল কারীমের দাওর করতেন। তাই যত সম্ভ¢ব এ মাসে বেশি বেশি তিলাওয়াত করবে। ইমাম আবু হানীফা রহ. রমযান মাসে প্রতিদিন দুইবার কুরআন খতম করতেন। এভাবে শুধু এক মাসে ষাটটি খতম করতেন।
    আমাদের নিকট-অতীতের একজন আলেম হযরত ইবনে আবেদীন শামী রহ.। তার জীবনীতে পাওয়া যায়, তিনি প্রতিদিন একবার কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করতেন। কিন্তু এটা জরুরি নয়, প্রতিদিন একবার কুরআন খতম করা লাগবে। তবুও নিজের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী যত বেশি সম্ভব কুরআন তিলাওয়াত করবে। বিশেষ করে তিন কালিমা, ইস্তিগফার এবং দরূদ শরীফকে মা’মূল [নিত্য আমল] বানিয়ে নিবে। চলতে-ফিরতে, ওঠতে-বসতে সব সময় আল্লাহর যিকির যবানে চালু রাখবে।

    এই মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে
    উচিত তো হলো এই মাস এমনভাবে কাটাবে, কোনো গুনাহই যেন না হয়। নিজের হাত, পা, মুখ, চোখ, কান ও মস্তিষ্ক সবকিছুকেই গুনাহ থেকে রক্ষা করবে। এই মাসে চোখ নাজায়িয দৃষ্টিপাত করবে না। জবান থেকে গলদ কথা বের হবে না। কান কোনো গুনাহের কথা শুনবে না। এ সংকল্প থাকলে রোযার হাকীকত ও তাৎপর্য লাভ হবে। নতুবা খুবই অবাকের বিষয় হবে, রোযার কারণে স্বাভাবিক হালাল বস্তু তথা পানাহার ইত্যাদি তো বর্জন হবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে হারাম কাজ-কর্ম জারি থেকে যাবে।
    মিথ্যা বলা, গীবত করা, কারো মনে কষ্ট দেয়া, ঝগড়া-বিবাদ করা, গালি-গালাজ করা, ধোঁকা দেয়া এবং খেয়ানত করা এগুলো আগে থেকেই হারাম ছিল, তারপরও তা করতে থাকল। অর্থাৎ হালাল জিনিস ত্যাগ করল, কিন্তু হারাম কাজ বর্জন করল না। তাহলে এ রোযাতে রূহানিয়াত এবং বরকত কোত্থেকে আসবে?

    রমযানে গুনাহ থেকে বাঁচা সহজ
    অতএব প্রথম দিন থেকেই এই সংকল্প করে নিবে, রমযানে গুনাহর নিকটেও যাব না। আল্লাহ তাআলা এই মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজও করে দিয়েছেন। কেননা এই মাসে শয়তানদেরকে বন্দি করে রাখা হয়। তাদের প্ররোচিত করার যোগ্যতা বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। -সহীহ মুসলিম : ২/৭৫৮
    অতএব গুনাহর প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য শয়তানী চক্রান্ত আক্রমণ করবে না। যদি করেও তবে আমাদের নফস করবে। রমযানের পূর্বে গুনাহর প্রতি উদ্বুদ্ধকারী দু’টি জিনিস ছিল, নফস ও শয়তান। রমযানে শয়তানের তৎপরতাকে আল্লাহ বন্ধ করে দেন। শুধু নফসের ক্রিয়া বাকি থাকে। এক শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলা করা তুলনামূলক সহজ। তাই এখন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাও সহজ হবে।

    হালাল রুজির প্রতি যত্নবান হবে
    এ মোবারক মাসে হালাল রুজীর প্রতি যতœবান হওয়াও অত্যাবশ্যক। যে লোকমা মুখে যাচ্ছে তা যেন হালাল হয়। নতুবা এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার হবে, সারাদিন আল্লাহর জন্য ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকবে, আর সন্ধ্যাবেলা হারাম জিনিস দ্বারা ইফতার করবে [আসতাগফিরুল্লাহ]।
    হযরত থানভী রহ. তো এ কথা পর্যন্ত বলেছেন, কারো যদি উপার্জন হারাম হয়, আর এ মূহুর্তে পরিবর্তন করা সম্ভব না হয় তবে কমপক্ষে এতটুকু সংকল্প করে নিবে, অন্তত রমযান মাসে হারাম উপার্জন থেকে খাবে না। কোথাও থেকে ঋণ নিয়ে তা দিয়ে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করবে। যাতে করে কমপক্ষে রমযান মাসে যে লোকমা গলা দিয়ে যাবে তা যেন হারাম না হয়। যদি এভাবে যতেœর সাথে রমযান কেটে যায় তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন,
    من سلمت له رمضان سلمت له سنة
    অর্থাৎ যার রমযান ভালোভাবে কেটে যাবে তার গোটা বছর ভালোভাবে কাটবে। আর আল্লাহ তাআলা তো গুনাহ মাফ করার বাহানা তৈরি করে দিয়েছেন। বলেছেন-
    من صام رمضان ايمانًا واحتسابًا غفر له ما تقدم من ذنبه
    অর্থাৎ যে মুমিন অবস্থায় সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখল তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে গেল। অপর এক হাদীসে রয়েছেÑ
    من قام رمضان ايمانًا واحتسابًا غفر له ما تقدم من ذنبه
    অর্থাৎ যে ঈমান অবস্থায় সওয়াবের আশা রেখে রাতের তারাবী পড়বে তার সমস্ত গুনাহ মাফ। যে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করবে তাকেও ক্ষমা করে দেয়া হবে। -তিরমিযী : ১/৮৬
    আল্লাহ তাআলা প্রতিটি কদমে কদমে ক্ষমার ওয়াদা করেছেন।

    সকল ইবাদতের সময় সুসংবাদের কথা মনে করবে
    এজন্য প্রত্যেকটি আমলের ক্ষেত্রে খেয়াল ক?

  • ভুলে যাকাত বেশি আদায় করে ফেললে তার বিধান

    প্রশ্ন: কেউ যদি যাকাতের পরিমান ভুল হিসাব করে আদায় করে ফেলে এবং আদায়কৃত যাকাতের পরিমান যদি আসল যাকাত থেকে বেশী হয়, তবে কি তা ভুল হিসেবে বিবেচিত হবে?
    ধরা যাক, গত ১ বছরের হিসাবে আমার যাকাতের পরিমান ৩০,০০০ টাকা। কিন্তু ভুল হিসাবের কারণে আমি ৩৫,০০০ টাকা যাকাত আদায় করেছি। নির্ধারিত পরিমানের অধিক আদায় করাতে কি আমার ভুল হয়েছে? যদি ভুল না হয়, তবে কি পরবর্তী বছর আমি নির্দিষ্ট পরিমানের ৫০০০ টাকা কম আদায় করতে পারবো?

    উত্তর: যেহেতু কম দেয়া হয় নি, বেশি দেয়া হয়েছে, তাই হিসাব ভুল হলেও যাকাত আদায় হয়ে গেছে৷
    এখন প্রশ্ন রইল অতিরিক্ত ৫ হাজারের৷ এই অতিরিক্ত টাকাগুলো পরের বছরের যাকাতে যোগ হবে৷
    ولو مر بأصحاب الصدقات فأخذوا منه اكثر مما عليه ظنا منهم أن ذلك عليه لما أن ماله أكثر يحتسب الزيادة للسنة الثانية.
    (المحيط البرهانى: ٣/٢٢٦)
    “যদি যাকাত উসুলকারী যদি যাকাত দাতার কাছ থেকে (শরীয়ত) নির্ধারিত পরিমাণের বেশি উসুল করে নেয়, এই ধারণা করে যে, মনে হয় অতিরিক্ত এইটুকুও তার উপর যাকাত আসে, তাহলে অতিরিক্ত যা উসুল করা হয়েছিল, তা পরের বছরের যাকাতে গণ্য হবে৷” (আল-মুহীত: ৩/২২৬)
    সেই হিসেবে এই ৫ হাজার টাকা পরের বছরের যাকাতের হিসাবে যোগ হবে৷
    والله تعالى أعلم.
    উত্তর প্রদানে- মুফতি জিয়াউর রহমান

  • প্রশ্ন: আমি জানতে চাই শুক্রবারে এবং রামাযানের দিন মৃত্যুতে কোন সওয়াব আছে কি? আমি শুনেছি হাদিসে এসেছে, কেউ যদি শুক্রবারে মারা যায় তাহলে তাঁর কবরের আজাব মাফ হয়ে যায়? এরকম হাদিসের ব্যাখ্যা জানতে চাই

    উত্তর: জুমআর দিন ইন্তেকাল করলে আল্লাহ তা’আলা ওই ব্যক্তিকে কবরের আযাব থেকে হেফাজত করবেন৷ এরকম হাদীস বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে এসেছে৷
    عن عبد الله بن عمرو، عن النبي صلى الله عليه وسلم، قال: ما من مسلم يموت يوم الجمعة إلا وقاه الله فتنة القبر.
    (رواه الترمذي: (١٠٧٤) وأحمد (٢/١٦٩) (٦٥٨٢). والحديث صحيح بمجموع طرقه أو حسن.
    “আবদুল্লাহ বিন আমর রা, হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে কোন মুসলিম জুমু‘আর দিন বা জুমু‘আর রাতে মারা গেল আল্লাহ তা‘আলা তাকে অবশ্যই কবরের আযাব থেকে রেহাই দেবেন৷” (তিরমিযী: ১০৭৪, আহমাদ: ৬৫৮২)

    সব সূত্র মিলিয়ে হাদীসটি সহীহ অথবা হাসান থেকে কম নয়৷ তাই হাদীস দলীলযোগ্য৷

    যেহেতু শুক্রবারের বিশেষ ফযীলত রয়েছে, আশা করা যায় শুক্রবারের বরকতে আল্লাহ তাআলা তার কবরের আযাব মাফ করে দিতে পারেন৷

    রামাযান মাস হলো নেক আমলের মওসুম, আর নেক আমল হলো জান্নাত লাভের উপায়৷ আল্লাহ তাআলা বলেন:
    ادْخُلُواْ الْجَنَّةَ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ.
    (سورة النحل: ٣٢)
    “তোমরা যে আমল করতে, তার প্রতিদানে জান্নাতে প্রবেশ করো৷” (সূরা আন-নাহল: ৩২)
    যেহেতু রামাযান মাসে জান্নাতের দরজা খোলা থাকে, জাহান্নামের দরজা বন্ধ থাকে, তাই রোজাবস্থায় মারা গেলে জান্নাতের আশা করা যায়৷
    নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাআইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
    إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة وغلقت ابواب جهنم وصفدت الشياطين.
    (رواه البخارى: ١٨٩٨ و مسلم: ١٠٧٩)


    উত্তর প্রদানে: মুফতি জিয়াউর রহমান

  • মান্নতের রোযার সঙ্গে নফলের নিয়ত করা

    প্রশ্ন: মান্নতের রোযার সঙ্গে কী যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের নফল রোযার নিয়ত করা যাবে?

    بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

    উত্তর: রোযার ক্ষেত্রে একই সঙ্গে একই বিষয়ে দুই নিয়ত করা যাবে না৷ হয়ত আপনি আপনার কৃত মান্নতের ওয়াজিব রোযা আদায় করবেন৷ নতুবা যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের নফল সিয়াম পালন করবেন৷ যে কোনো একটি নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে৷

    কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-

    يُوفُونَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُونَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيرًا

    অর্থ: তারা মান্নত পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে, যেদিনের অনিষ্ট হবে সুদূরপ্রসারী। (সূরা দাহর: ৭)

    হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

    عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا عَنْ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيعَ اللهَ فَلْيُطِعْهُ وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِيَهُ فَلَا يَعْصِهِ

    অর্থ: আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করার নযর মানে, সে যেন তার আনুগত্য করে (পুরা করে) এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করার নযর মানে, সে যেন (তা পুরণ না করে এবং) তাঁর অবাধ্যতা না করে। (সহীহ বুখারী হাদীস ক্রম: ৬৬৯৬)

    وَمَتَى نَوَى شَيْئَيْنِ مُخْتَلِفَيْنِ مُتَسَاوِيَيْنِ فِي الْوَكَادَةِ وَالْفَرِيضَةِ، وَلَا رُجْحَانَ لِأَحَدِهِمَا عَلَى الْآخَرِ بَطَلَا، وَمَتَى تَرَجَّحَ أَحَدُهُمَا عَلَى الْآخَرِ ثَبَتَ الرَّاجِحُ

    অর্থ: যখন দুটি ভিন্ন বিষয়ের নিয়ত করা হয়, যার গুরুত্ব ও ফরয হওয়ার ক্ষেত্রে সমান হয়৷ এবং একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে দুটো আমলই বাতিল হয়ে যাবে৷ আর যখন একটার উপর আরেকটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে, তখন প্রাধান্যপ্রাপ্তটাই সাব্যস্ত হবে৷ (ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া: ১/১৯৬)

    وإن نوى النذر المعين والتطوع ليلاً أو نهاراً أو نوى النذر المعين، وكفارة من الليل يقع عن النذر المعين بالإجماع

    অর্থ: আর যদি নির্দিষ্ট মান্নতের ও নফল রোযার নিয়ত করা হয় দিনে অথবা রাতে অথবা নির্দিষ্ট মান্নতের ও কাফফারার নিয়ত করা হয় রাতে, তাহলে সর্বসম্মতভাবে নির্দিষ্ট মান্নতের রোযা আদায় হবে৷

    ولو نوى قضاء رمضان والتطوع كان عن القضاء في قول أبي يوسف رحمه الله.
    অর্থ: যদি রামাযানের কাযা এবং মুল রোযার নিয়ত করা হয়, তাহলে ইমাম আবু ইউসুফ রাহিমাহুল্লাহর মতে কাযা আদায় হবে৷ (আল-বাহরুর রায়িক: ২/২৯৯)

    তাই প্রশ্নে বর্ণিত ক্ষেত্রে আপনার শুধু মান্নতের রোযা আদায় হবে৷ তবে পৃথকভাবে যিলহজ্বের রোযার নিয়ত করলে যিলহজ্বের নফল হিসেবেই গণ্য হবে৷

    واللہ تعالٰی أعلم بالصواب.
    উত্তর প্রদানে-
    মুফতি জিয়াউর রহমান

  • প্রশ্ন: রোযা রাখা অবস্থায় ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে রোযার হুকুম কী?

    بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

    উত্তর: রোযা পালনরত অবস্থায় যদি দিনের বেলা যে কোনে সময় ঋতুস্রাব শুরু হয়ে যায়, তাহলে এই রোযা ভেঙ্গে যাবে৷ পুনরায় এই রোযার কাযা রাখতে হবে৷ কেননা নফল রোযা শুরু করে দিলে ওয়াজিব হয়ে যায়৷

    عن عائشةَ رَضِيَ اللهُ عنها قالت: كان يُصيبُنا ذلك على عَهدِ رَسولِ الله صلَّى اللهُ عليه وسلَّم، فنُؤمَرُ بقَضاءِ الصَّومِ، ولا نُؤمَرُ بقَضاءِ الصَّلاةِ.
    অর্থ: আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন: রাসূল ﷺ-এর যামানায় আমরা এ (হায়েয) অবস্থায় পতিত হলে আমাদেরকে রোযার কাযা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হতো কিন্তু নামাযের কাযা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হতো না। (বুখারী হাদীস নং-৩২১ মুসলিম হাদীস নং-৩৩৫)

    ان الشروع في التطوع سبب الوجوب كالنذر فإذا وجب المضي فيه وجب القضاء بالإفساد.

    অর্থ: নফল ইবাদত শুরু করা ওয়াজিব হওয়ার কারণ, যেমন মান্নত৷ সুতরাং শুরু হওয়া সাব্যস্ত হয়ে গেলে ফাসিদ করার কারণে তার কাযা ওয়াজিব হবে৷ (বাদায়িউস সানায়ি’: ২/২১৯)

    وأما في حالة تحقق الحیض و النفاس فیحرم الإمساك؛ لأن الصوم منهما حرام، والتشبه بالحرام حرام. (طحطاوی علی المراقی: ص : ۳۷۰)

    অর্থ: হায়েয ও নেফাস শুরু হয়ে গেলে রোযা অবস্থায় থাকা হারাম৷ কেননা এই দিনসমূহে রোযা রাখা হারাম৷ আর হারামের সাথে সামঞ্জস্য রাখাও হারাম৷ (তাহত্বাভী আলাল-মারাকী পৃষ্ঠা: ৩৭০)

    من دخل في صلاة التطوع أو في صوم التطوع ثم أفسده قضاه.
    অর্থ: কেউ যদি নফল নামায বা নফল রোযা শুরু করে, তারপর তা ফাসিদ করে ফেলে, তাহলে তার কাযা করবে৷ (আল-হিদায়া: ২/১২৩)

    واللہ تعالٰی أعلم بالصواب.

    উত্তর প্রদানে-
    মুফতি জিয়াউর রহমান