Blog

  • প্রশ্ন: নফল রোযার সঙ্গে কী কাযা রোযার নিয়ত করা যাবে?


    بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

    উত্তর: কাযা রোযা এবং নফল রোযা ভিন্ন ভিন্ন বিষয়৷ কাযার নিয়তে রোযা রাখলে কাযা-ই আদায় হবে৷ নফলের নিয়ত করলে নফল আদায় হবে৷ কারো নিজের যিম্মায় অনেকগুলো কাযা রোযা থাকলেও সময়ে সময়ে বিভিন্ন নফল রোযা যেমন, সোম-বৃহস্পতিবারের রোযা, আইয়্যামে বীযের রোযা, শাওয়াল মাসের রোযা, যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের রোযা, আশুরার রোযা ইত্যাদি নফল রোযা রাখা যাবে৷ কোনো সমস্যা নেই৷ তবে কাযা রোযাগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেখে দিতে হবে৷

    আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

    فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ
    অর্থ: কাজেই তোমাদের যে ব্যক্তি এই মাসটি পাবে, সে এ মাসে সিয়াম পালন করবে। আর যে ব্যক্তি অসুস্থ বা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে এ সংখ্যা পূরণ করবে। (সূরা বাকারা: ১৮৫)

    সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযার ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন-

    تُعْرَضُ الأَعْمَالُ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ، فَأُحِبّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ.

    অর্থ: সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমলসমূহ পেশ করা হয়। তো আমার পছন্দ, আমার আমল যেন পেশ করা হয় আমি রোযাদার অবস্থায়। (জামে তিরমিযী হাদীস নং-৭৪৭)

    তবে রামাযানের কাযা রোযার সাথে সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযার নিয়ত করলে আদায় হবে না৷ বরং কাযা এবং সোম-বৃহস্পতিবারের রোযা পৃথক পৃথকভাবে রাখতে হবে৷

    وإذا نوى قضاء بعض رمضان والتطوع يقع عن رمضان في قول أبي يوسف رحمه الله تعالى، وهو رواية عن أبي حنيفة رحمه الله تعالى.
    অর্থ: যদি রামাযানের কাযা এবং নফলের নিয়ত করা হয়, তাহলে ইমাম আবু হানীফা রাহ. ও ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. এর মত হলো এতে রামাযানের কাযা আদায় হবে৷ (আল-বাহরুর রায়িক: ২/২৯৯, আল-হিন্দিয়া: ১/১৯৬)

    واللہ تعالٰی أعلم بالصواب.

    উত্তর প্রদানে—মুফতি জিয়াউর রহমান

  • সুবহে সাদিকের পরও খাওয়া অব্যাহত রাখলে রোযার বিধান

    প্রশ্ন: আমি অনেকগুলো রোযা রেখেছি আযান পর্যন্ত সাহরি খেয়ে। আমার রোযা কী হবে?

    بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

    উত্তর: যদি আপনি সুবহে সাদিক হওয়ার পরও খাওয়া অব্যাহত রেখেছেন বলে নিশ্চিত হন, তাহলে এ ক্ষেত্রে আপনার রোযা হবে না৷ এ অবস্থায় যত রোযা রেখেছেন, সবগুলো রোযার কাযা রাখতে হবে৷

    وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ۖ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْل

    অর্থ: আর পানাহার কর যতক্ষণ না কালোরেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়।
    (সূরা বাকারা: ১৮৭)

    وإذا تسحر وهو يظن أن الفجر لم يطلع فإذا هو قد طلع (إلي قوله) وعليه القضاء.
    অর্থ: ফজর হয় নি মনে করে যদি সাহরি খেতে থাকে অথচ ইতোমধ্যেই সুবহে সাদিক হয়ে যায়, তাহলে এই রোযার কাযা রাখতে হবে৷ (আল-হিদায়া, কিতাবুস সাওম: ১/২০৫)

    (২) রোযাবস্থায় টুথপেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করলে গলায় তার স্বাদ অনুভূত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই মাকরুহ হবে৷ তবে যদি নিশ্চিতভাবে পেস্টের কোনো অংশ গলা হয়ে পেটে চলে যায়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে৷ তাই রোযাবস্থায় টুথপেস্ট, টুথপাউডার, মাজন ইত্যাদি দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা ঠিক নয়৷ মেসওয়াক বা খালি ব্রাশ দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করতে কোনো সমস্যা নাই৷

    প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা রাহিমাহুল্লাহ বলেন:

    وَلَا يَمْضُغُ الْعِلْكَ فَإِنِ ازْدَرَدَ رِيقَ الْعِلْكَ لَا أَقُولُ: إِنَّهُ يُفْطِرُ وَلَكِنْ يُنْهَى عَنْهُ.

    অর্থ: আর রোযাবস্থায় কোনো ব্যক্তি যেন কোনো কিছু না চিবায়। যদি চিবানোর কারণে তার রস গিলে ফেলে, তাহলে তার ক্ষেত্রে আমি বলি নি যে, সে রোযা ভঙ্গ করল, বরং তা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। (বুখারী হাদীস নং-২০১৮)

    وكره له ذوق شيئ وكذا مضغه بلا عذر.
    অর্থ: কোনো জিনিসের স্বাদ অনুভব হলে বা চিবালে রোযা মাকরুহ হবে৷ (আদ্দুররুল মুখতার: ৩/৩৯৫)

    আপনার জন্য করণীয় হচ্ছে, অনুমান করে যে রোযাগুলো ভেঙ্গে গেছে বা হয় নি বলে প্রবল ধারণা হয়, পরবর্তীতে সেগুলোর কাযা করে নিবেন৷ তবে শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে রোযা হয় নি বলে অস্থির হওয়া ঠিক হবে না৷ নিশ্চিত বা প্রবল ধারণা হলেই কেবল কাযা আদায় করবেন৷

    এসব নিয়ে মানসিক অস্থিরতার কোনো প্রয়োজন নেই৷ আল্লাহ তাআলা তো এর বিকল্প কাযা রেখেছেন৷ যেহেতু ইচ্ছাকৃত করেন নাই, তাই কাযা আদায় করে নিলে আল্লাহ তাআলা মাফ করবেন৷ আপনার এই অস্থিরতা ওয়াসওয়াসা থেকেও হতে পারে৷ তাই ওয়াসওয়াসাকে জায়গা দেওয়া যাবে না৷

    واللہ تعالٰی أعلم بالصواب.

    উত্তর প্রদানে—মুফতি জিয়াউর রহমান

  • নারীদের নামাযের পদ্ধতি পুরুষদের মতো নাকি আলাদা

    প্রশ্ন: নারীরা কী পুরুষদের মতো নামায পড়বে? নাকি তাদের পৃথক নামাযের পদ্ধতি আছে?

    (২) নারীদের নামাযে পদ্ধতিগতভাবে পুরুষদের থেকে কিছু পার্থক্য রয়েছে৷ নারী-পুরুষের শারীরীক গঠন, সক্ষমতা, নিরাপত্তা, সতর ও পর্দা ইত্যাদি নানা বিষয়ে যেমন পার্থক্য রয়েছে, ঠিক তেমনি ইবাদতের ক্ষেত্রেও কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত৷

    ইসলামের অধিকাংশ বিধানেও নারী-পুরুষের পার্থক্য রাখা হয়েছে৷ পুরুষকে নারীদের এবং নারীদের পুরুষের সামঞ্জস্য এবং সাদৃশ্য ধারণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে৷ এক হাদীসে এসেছে-

    ﻟَﻌَﻦَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﺍﻟﻤُﺘَﺸَﺒِّﻬِﻴﻦَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺮِّﺟَﺎﻝِ ﺑِﺎﻟﻨِّﺴَﺎﺀِ، ﻭَﺍﻟﻤُﺘَﺸَﺒِّﻬَﺎﺕِ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀِ ﺑِﺎﻟﺮِّﺟَﺎﻝِ.

    অর্থ: রাসূলুল্লাহ ﷺ অভিশাপ দিয়েছেন, যেই পুরুষরা মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং যে মহিলারাও পুরুষদের সদৃশ্য অবলম্বন করে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-৫৮৮৫)

    নারীদের নামাযে পদ্ধতিগত পার্থক্যের বিবরণ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বর্ণনা থেকে-

    عن يزيد بن أبي حبيب، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على امرأتين تصليان فقال: إذا سجدتما فضمَّا بعض اللحم إلى الأرض؛ فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل.

    অর্থ: তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব রাহ. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ নামাযরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্যে) বললেন, যখন সাজদা করবে, তখন শরীর যমীনের সাথে মিলিয়ে দিবে৷ কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়৷
    (কিতাবুল মারাসীল, ইমাম আবু দাউদ হাদীস নং-৮০, আস-সুনানুল কুবরা বাইহাকী হাদীস নং-৩০১৬, ২/২২৩, হাদীসটি ইমামগণের উসূল অনুযায়ী দলীলযোগ্য- নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান, আওনুল বারী: ১/৫২০, মুহাদ্দিস শুয়াইব আল-আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন৷)

    পার্থক্যের বিবরণ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমার বর্ণনা থেকে-

    عَنْ بُكَيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ الأَشَجِّ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ؛ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ صَلاَةِ الْمَرْأَةِ؟ فَقَالَ: تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِزُ. (مصنف ابن ابى شيبة، كتاب الصلاة، في المرأة كَيْفَ تَجْلِسُ فِي الصَّلاَةِ، رقم الحديث-2794)

    অর্থ: বুকাইর ইবনু আবদিল্লাহ থেকে বর্ণিত, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমাকে জিজ্ঞেস করা হলো- মহিলারা কিভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন- খুব জড়োসড়ো হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে। (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৪)

    তাই নামাযের কতিপয় পদ্ধতি যেমন- তাকবীরে তাহরীমার জন্যে হাত উঠানো, হাত বাঁধা, রুকু, সাজদা, বৈঠক ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে পুরুষের সাথে নারীর পার্থক্য রয়েছে৷ যে পার্থক্যের বিবরণ খোদ রাসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছেন৷ সাহাবায়ে কেরাম দিয়েছেন৷

    নামাযে হাত উঠানো বিষয়ক পার্থক্য-

    عن وائل بن حجر قال: قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم: يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها (المعجم الكبير، باب الواو رقم الحديث-28)

    অর্থ: হযরত ওয়াইল বিন হুজর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন। আমাকে নবীজী ﷺ বলেছিলেন যে, হে ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর।
    (আল মুজামুল কাবীর, হাদিস নং-২৮, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা: ১/২৩৯, মুনতাখাব কানযুল উম্মাল আলা হামিশি মুসনাদে আহমদ: ৩/১৭৫, মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ২/১০৩, হাদিসটির সনদ হাসান।)

    سُئِلَ عَطَاءً عَنِ الْمَرْأَةِ كَيْفَ تَرْفَعُ يَدَيْهَا فِي الصَّلَاةِ، قَالَ: حَذْوَ ثَدْيَيْهَا.
    অর্থ: হযরত আতা ইবনু আবী রাবাহ রাহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো, নামাযে মহিলা কতটুকু হাত উঠাবে? তিনি বললেন, বুক বরাবর৷ (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা: ২৪০১, ১/২৭০)

    وإذا أراد الدخول في الصلاة كبر ورفع يديه حذاء أذنيه والمرأة أنها ترفع حذاء منكبيها.
    অর্থ: যখন নামায শুরু করতে চাইবে, তাকবীর বলবে এবং দুই হাত কান বরাবর উঠাবে৷ আর মহিলা হাত উঠাবে কাঁধ বরাবর৷ (আল-বাহরুর রায়িক: ১/৩০৫)

    হাত বাঁধার স্থান বিষয়ক নারী-পুরুষের পার্থক্য:

    পুরুষরা হাত নাভীর নিচে বাঁধবে, আর নারীরা বুকের উপর হাত বাঁধবে৷ যদিও পুরুষদের নাভীর উপরে হাত বাঁধার বিবরণও রয়েছে, কিন্তু অগ্রাধিকারযোগ্য মত হলো, পুরুষরা নাভীর নিচে হাত বাঁধবে৷ আর নারীরা বুকের উপর৷

    عن علقمة بن وائل بن حجر، عن أبيه قال: رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.
    অর্থ: হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি নবী কারীম ﷺকে দেখেছি, তিনি নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নীচে রেখেছেন। (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা, হাদীস নং- ৩৯৫১)

    عن أبي جحيفة أن عليا رضي الله عنه قال: السنة وضع الكف على الكف في الصلاة تحت السرة.

    অর্থ: হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুন্নাহ হচ্ছে নামাযে হাতের পাতা হাতের পাতার উপর নাভীর নিচে রাখা।(মুসনাদে আহমদ হাদীস নং- ৮৭৫, আবু দাউদ হাদীস নং- ৭৫৬, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা হাদীস নং- ৩৯৬৬)

    بخلاف المرأة فإنها تضع علي صدرها، لأنه أستر لها فيكون في حقها أولي.
    অর্থ: ঠিক বিপরীত হলো নারীদের বিষয়টি, তারা হাত রাখবে বুকের উপর৷ কেননা এটা তাদের জন্য অধিক আবরণকারী এবং তাদের জন্য সর্বোত্তম৷ (ই’লাউস সুনান: ২/১৫৩)

    وأما المرأة فإنها تضعهما تحت ثدييها بالإتفاق لأنه استر لها
    অর্থ: উম্মতের ইজমা হলো, মহিলা হাত বাঁধবে বুকের নিচে৷ কেননা এটা তাদের জন্য অধিক আবরণকারী৷ (গুনইয়াতুল মুতামাল্লী কাবীরী পৃষ্ঠা: ২৯৪)

    সাজদার পদ্ধতিগত পার্থক্য:

    পুরুষ এমনভাবে সাজদা করবে যে, পেট উরু থেকে এবং হাতকে পার্শ্ব থেকে পৃথক রাখবে৷ এবং কনুই জমিন থেকে আলাদা রাখবে৷ আর নারীরা পেটকে উরুর সাথে এবং হাতকে পার্শ্বের সাথে মিলিয়ে রাখবে৷ এবং কনুইকে জমিনের উপর বিছিয়ে রাখবে৷

    عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم: إِذَا جَلَسْت الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا

    অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত রাসূল ﷺ ইরশাদ করেছেন- মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে, তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সাজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে, যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। (সুনানে বায়হাকী-২/২২৩, হাদিস নং-৩৩২৪, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা: ১/২৭০, কানযুল উম্মাল: ৮/২২৩, হাদিসটির সনদ হাসান।)

    বসার পদ্ধতিগত পার্থক্য:

    পুরুষ তো নামাযে এমনভাবে বসবে যে, ডান পায়ের পাতা দাঁড়ানো থাকবে আর বাম পা বিছিয়ে এর উপর বসবে৷ আর মহিলারা তাদের উভয় পা ডানদিকে বের করে নিতম্বের উপর বসবে৷
    عن عائشة رضي الله عنها قالت كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يفتتح الصلاة بالتكبير… وكان يفترش رجله اليسري وينصب اليمني.
    আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ নামায তাকবীর বলে শুরু করতেন৷… আর বাম পা বিছিয়ে বসতেন এবং ডান পা দাঁড়িয়ে রাখতেন৷ (সহীহ মুসলিম হাদীস নং-৪৯৮, আবু দাউদ হাদীস নং-৭৮৩, মুসনাদে আহমাদ হাদীস নং-২৪০৩০)

    عَن خَالِدِ بْنِ اللَّجْلاَجِ ، قَالَ : كُنَّ النِّسَاءُ يُؤْمَرْنَ أَنْ يَتَرَبَّعْنَ إذَا جَلَسْنَ فِي الصَّلاَةِ ، وَلاَ يَجْلِسْنَ جُلُوسَ الرِّجَالِ عَلَى أَوْرَاكِهِنَّ ، يُتَّقي ذَلِكَ عَلَى الْمَرْأَةِ ، مَخَافَةَ أَنْ يَكُونَ مِنْهَا الشَّيءُ.

    খালিদ ইবনুল-লাজলাজ রাহ. বলেন- মহিলাদেরকে আদেশ করা হতো যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মত না বসে। আবরণযোগ্য কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় মহিলাদেরকে এমনি করতে হয়। (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা-১/৩০৩, হাদিস নং-২৭৯৯)

    والمرأة علي إليتها اليسري في القعدتين وتخرج كلتا رجليها من الجانب الآخر أي الأيمن؛ لأن ذالك أستر لها.

    অর্থ: মহিলা নামাযে বসবে বাম নিতম্বের উপর আর দুই পা ডানদিকে বের করে রাখবে৷ এটাই তাদের সতরের জন্য অধিক উপযোগী। (গুনইয়াতুল মুতামাল্লী কাবীরী পৃষ্ঠা: ২৯৪)

    উপরে নামাযের বিভিন্ন অবস্থার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ থেকে বোঝা গেলো, নারী-পুরুষের নামাযে পদ্ধতিগত অনেকগুলো পার্থক্য রয়েছে৷ তাই নারীরা নারীদের নিয়মেই নামায আদায় করবে৷ পুরুষের মতো করে নয়৷

    তবে যে সমস্ত মা-বোন ইতোমধ্যে পুরুষের মতো একই পদ্ধতিতে নামায আদায় করেছেন, তাদের নামাযও বাতিল হয় নাই৷ কেননা এগুলো নামায বাতিল বা নষ্ট হওয়ার মতো বিষয় নয়৷ তবে অবশ্যই নিয়ম পরিপন্থী হয়েছে৷ তাই ভবিষ্যতে নারীদের জন্য শরীয়ত বিবৃত পৃথক নিয়মেই নামায আদায় করা উচিত৷

    واللہ تعالٰی أعلم بالصواب.
    উত্তর প্রদানে-
    মুফতি জিয়াউর রহমান

  • নারীর জন্য জবের জায়গায় নামায পড়া কষ্টকর হলে করণীয়

    প্রশ্ন: আমি একজন নারী, দ্বীন মেনে চলার চেষ্টা করি, পর্দা করি। কিন্তু জীবিকার তাগিদে বাইরে জব করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাইরে নামায আদায় করা কঠিন হয়ে যায়। আমার করণীয় কী?

    بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

    উত্তর: নারীদের জন্য বাইরের পরিবেশ বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ৷ নিজের ফরয ইবাদত ও ফরয পর্দা রক্ষার ক্ষেত্রে বড়ই প্রতিকূল৷ তাই দুআ করি আল্লাহ তাআলা আপনার জন্য ঘরে বসেই উত্তম ও হালাল রিযিকের ব্যবস্থা করে দিন৷ যাতে বাইরের কষ্টকর ও আমলের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে যান৷

    আপনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে দ্বীন পালনে প্রতিকূল পরিবেশে থেকে জব করছেন৷ ব্যাপারটি নিয়ে আপনি নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন৷ আপনার জন্য সমবেদনা রইল৷

    পর কথা হলো, প্রত্যেক মুমিনের জন্য যথাসময়ে নামায আদায় করা ফরয৷ স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো উযর ছাড়া নামায কাযা করা জায়েয নয়৷ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

    إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا

    অর্থ: নিঃসন্দেহে মুমিনদের প্রতি নামায অপরিহার্য রয়েছে, যার সময়সীমা নির্ধারিত। (সূরা নিসা ১০৩)

    আপনি যদি ঠেকায় পড়ে জবটা করতেই হয়, তাহলে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে সময়মত নামাযগুলো আদায় করতে৷ এক্ষেত্রে গাড়ীতে থাকা আপনার কলিগদের উচিত ছিলো সময়মত নিজেরা নামায আদায় করা এবং আপনাকেও নামাযের জন্য সুযোগ দেয়া৷ কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা তো নামায পড়েই না, আপনাকেও সময়মত নামায আদায় করতে বাধা দেয়৷ দুআ করি আল্লাহ তাদের বুঝ দান করুন৷

    যদি কোনো উপায়ান্তর না থাকে, তাহলে গাড়ীর সিটে বসে ইশারায় নামায আদায় করে নিবেন৷ পরবর্তীতে ঘরে গিয়েই এই নামায পুনরায় পড়ে নিবেন
    مسافر لا يقدر علي الأرض يصلي بالإيماء إذا خاف فوت الوقت.
    অর্থ: কোনো মুসাফির যদি জমিতে (নেমে) নামায আদায়ে সক্ষম না হয়, তাহলে ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে ইশারায় নামায আদায় করবে৷ (রদ্দুল মুহতার: ২/৪১)

    الأسير في يد العدو إذا منعه الكافر عن الوضوء والصلاة يتيمم ويصلي بالإيماء ثم يعيد إذا خرج
    অর্থ: শত্রুর হাতে বন্দী ব্যক্তিকে যদি ওযু এবং নামায থেকে বাধা দেয়, তাহলে তায়াম্মুম করে ইশারায় নামায আদায় করবে, এরপর এই নামায পুনরায় আদায় করবে৷ (আল-বাহরুর রায়িক: ১/২৪৮)

    صلي الفرض في فلك جار قاعدا بلا عذر صح لغلبة العجز وأساء وقالا لا يصح إلا بعذر وهو الأظهر برهانا
    অর্থ: কেউ উজর ছাড়া চলন্ত নৌকাতে ফরয নামায পড়ল, তাহলে অক্ষমতা প্রবল হওয়ার কারণে তার নামায সহীহ হয়ে যাবে৷ তবে সে ঠিক করে নি৷ সাহিবাইন বলেন: উজর ছাড়া এরকম পড়লে সহীহ হবে না৷ আর দালিলিকভাবে এটা তো সুস্পষ্ট বিষয়৷ (আদ্দুররুল মুখতার: ২/২০৬)

    দুআ করি আল্লাহ তাআলা আপনার বিষয়টি সহজ করে দিন৷ ঘরে বসে সম্মানজনক রিযিকের ব্যবস্থা করে দিন৷ আমীন৷

    واللہ تعالٰی أعلم بالصواب.

    উত্তর প্রদানে—মুফতি জিয়াউর রহমান

  • ওযুতে ঘাড় মাসাহের বিধান

    ওযুতে ঘাড় মাসাহ কী সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত? কেউ কেউ ঘাড় মাসাহ করাকে বিদআত বলে থাকেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন।

    بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

    উত্তর: কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা আমাদেররে ওযু শিক্ষা দিলেন এভাবে-
    يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُواْ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُواْ بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَينِ

    অর্থ: হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমণ্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং মাথা মাসাহ করো এবং পদযুগল গিট পর্যন্ত ধৌত করো।

    হযরত আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ রাযি. নবীজি ﷺ ওযু কিভাবে করতেন, সেটা দেখাতে গিয়ে এক পর্যায়ে দেখালেন-
    ثُمَّ مَسَحَ رَأْسَهُ بِيَدَيْهِ فَأَقْبَلَ بِهِمَا وَأَدْبَرَ بَدَأَ بِمُقَدَّمِ رَأْسِهِ حَتَّى ذَهَبَ بِهِمَا إِلَى قَفَاهُ ثُمَّ رَدَّهُمَا إِلَى الْمَكَانِ الَّذِي بَدَأَ مِنْهُ، ثُمَّ غَسَلَ رِجْلَيْهِ‏
    অর্থাৎ তারপর দু’হাত দিয়ে মাথা মাসাহ করলেন। অর্থাৎ হাত দু’টি সামনে এবং পেছনে নিলেন। মাথার সম্মুখ ভাগ থেকে শুরু করে উভয় হাত পেছনের চুলের শেষ প্রান্ত অর্থাৎ ঘাড় পর্যন্ত নিলেন। তারপর আবার যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, সেখানেই ফিরিয়ে আনলেন। তারপর দু’পা ধুলেন। (সহীহ বুখারী হাদিস: ১৮৫)

    ওযুতে ঘাড় তথা গর্দান মাসেহ করা মুস্তাহাব৷ কেউ কেউ যদিও এটিকে বিদআত বলেন৷ কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস ও সালাফ থেকে যে আমলটি প্রমাণিত, তা বিদআত বলা মোটেও ঠিক নয়৷

    عَنْ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنْ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ بِيَدَيْهِ عَلَى عُنُقِهِ وُقِيَ الْغُلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

    অর্থ: ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূল ﷺ ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি অজু করে এবং উভয় হাত দিয়ে গর্দান মাসাহ করে, তাকে কিয়ামতের দিন (আযাবের) বেড়ি পরানো থেকে বাঁচানো হবে। (নাইলুল আওতার: ১/২০৭)

    ইমাম আবুল হাসান ফারিস রাহ. বলেন:
    وَقَالَ هَذَا إنْ شَاءَ اللَّهُ حَدِيثٌ صَحِيحٌ
    ইনশাআল্লাহ হাদীসটি সহীহ।
    (তালখীসুল হাবীর-১/৯৩, নাইলুল আওতার: ১/২০৭)

    قال الحافظ ابن حجر في التلخيص : فيحتمل أن يقال هذا، وإن كان موقوفا فله حكم الرفع ، لأن هذا لا يقال من قبيل الرأي فهو على هذا مرسل انتهى

    অর্থাৎ ইবনু হাজার রাহ. তালখীসুল হাবীর নামক কিতাবে বলেন: বর্ণনাটি সম্পর্কে একথা বলা যায় যে, যদিও তা মাওকুফ (একজন তাবেয়ীর কথা) হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা মারফু’ (রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস) হিসাবে গণ্য হবে। কেননা, তিনি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এমন সংবাদ দেওয়া সম্ভব নয়।
    (তালখীসুল হাবীর: ১/১৬২ নাইলুল অাওতার: ১/২০৩)

    عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ إِذَا مَسَحَ رَأْسَهُ مَسَحَ قَفَاهُ مَعَ رَأْسِهِ
    অর্থ: হযরত ইবনে উমর রাযি. যখন মাথা মাসাহ করতেন, তখন মাথা মাসহের সাথে গর্দানও মাসাহ করতেন। (বায়হাকী হাদীস নং- ২৭৯)

    عَنْ طَلْحَةَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَضَّأَ فَمَسَحَ رَأْسَهُ هَكَذَا وَأَمَرَّ حَفْصٌ بِيَدَيْهِ عَلَى رَأْسِهِ حَتَّى مَسَحَ قَفَاهُ

    অর্থ: তালহা তিনি তার পিতা, তিনি তার দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমি নবীজী ﷺ কে দেখেছি, তিনি অজু করছেন। তখন তিনি এভাবে মাথা মাসাহ করেছেন, উভয় হাতকে একত্র করে তা দিয়ে গর্দান মাসাহ করতেন।  (মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা হাদীস নং- ১৫০)

    আল্লামা কাসানী রাহ. বাদায়েউস সানায়ে’তে লিখেন:
    قال أبو بكر الأعمش إنه سنة وقال أبوبكر الإسكاف إنه آداب.
    অর্থাৎ তাবেয়ী আবু বকর আ’মাশ রাহ. বলেন: ঘাড় মাসাহ করা সুন্নাত৷ আবু বকর ইসকাফ রাহ. বলেন: (ওযুতে) ঘাড় মাসাহ আদাব৷ (বাদায়েউস সানায়ে’ ১/৯৯)

    قال في الد المختار (في مستحبات الوضوء) ومسح الرقبة لظهر يديه (لاالحلقوم) لأنه بدعة.
    অর্থাৎ আদ্দুররুল মুখতারে ওযুর মুস্তাহাবসমূহের আলোচনায় বলা হয়েছে, এবং হাতের পৃষ্ঠদেশ দ্বারা ঘাড় মাসাহ (মুস্তাহাব)৷ গলা মাসাহ নয়, কেননা গলা মাসাহ বিদআত৷ (আদ্দুররুল মুখতার: ১/১২৪)

    সর্বশেষ কথা হলো, ঘাড় মাসাহের হাদীসসমূহ সহীহের মানে উন্নীত না হলেও সবগুলো রেওয়ায়াত মিলিয়ে হাসান লিগাইরিহীর পর্যায়ের৷ কেননা যঈফ হাদীস বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হলে তা হাসান লিগাইরিহী হয়ে যায়৷ তাছাড়া কোনো কোনো মুহাদ্দিস তো ‘ইনশাআল্লাহ’র সাথে সহীহ বলেছেন৷ যেমন উপরে ইমাম আবুল হাসান ফারিস রাহ.র উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে৷

    যার কারণে সাহাবা, তাবেয়ীন, ইমামগণ, মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কেরাম থেকে ঘাড় মাসাহের আমলটি প্রমাণিত৷ শুধু তাই নয়, আহলে হাদীস ভাইদের কাছে মান্যবর আলেমগণ থেকেও ওযুতে ঘাড় মাসাহের ব্যাপারটি ইতিবাচকভাবে প্রমাণিত৷ যেমন আল্লামা শাওকানী, আল্লামা বাগাভী, ইবনু সায়্যিদিন নাস, নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ৷
    والله تعالي أعلم بالصواب.
    উত্তর প্রদানে-
    মুফতি জিয়াউর রহমান

  • ইসলামে যাকাত: গুরুত্ব, তাৎপর্য ও বিধান

    যাকাত ইসলামের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিধান, নামাযের পরেই যার তাগিদ এবং তাৎপর্য সু-সাব্যস্ত৷ ইসলামের তৃতীয় রুকন হচ্ছে, এই যাকাত৷ যার কারণে কুরআনুল কারীমে বারবার নামাযের আলোচনার সঙ্গে যাকাত প্রদানের হুকুমও প্রদান করা হয়েছে এভাবে-

    ﻭَﺍَﻗِﯿْﻤُﻮﺍ ﺍﻟﺼَّﻠٰﻮﺓَ ﻭَ ﺍٰﺗُﻮﺍ ﺍﻟﺰَّﻛٰﻮﺓَ ؕ
    অর্থ: তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। (সূরা বাকারা: ৪৩)

    এরকম অনেক জায়গায় নামাযের হুকুমের পরপরই যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ বারবার বলা হয়েছে ‘যাকাত আদায় কর’ ‘যাকাত আদায় কর৷’ এর মৌলিক কারণ হলো, নামায আল্লাহর হক, আর যাকাত হচ্ছে বান্দার হক৷ কোনো মানুষ এই উভয় হক যথাযথভাবে আদায় না করলে ঈমানের পূর্ণতায় পৌঁছতে পারবে না৷ এজন্যে আল্লাহ তাআলা উভয় হকের আলোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একসঙ্গে এনেছেন৷

    আমল সাধারণত দুই প্রকার৷ ১- দৈহিক আমল৷ ২- আর্থিক আমল৷ যাকাত হচ্ছে, পুরোটাই আর্থিক আমল৷ যা ধনীদের উপর আল্লাহ তাআলা ফরয করেছেন৷ সুতরাং যাকাত কোনো আর্থিক জরিমানা বা টেক্স নয়, কেবলই একটি ইবাদত৷

    যাকাতের অর্থ

    যাকাতের দুই অর্থ:
    এক. বৃদ্ধি পাওয়া, বেড়ে যাওয়া, বারাকাত লাভ হওয়া৷
    اصل الزكاة النمو الحاصل عن بركة الله تعالي
    অর্থ: আল্লাহ প্রদত্ত বরকতের মাধ্যমে অর্জিত বৃদ্ধিই হচ্ছে যাকাতের মূল অর্থ৷ (আল-মুফরাদাত পৃষ্ঠা: ২১৮)

    দুই. পবিত্র হওয়া, পবিত্র করা৷ (আল-মুজামুল ওয়াসীত: ১/৩৯৬)

    যাকাতের নামকরণ ‘যাকাত’ বলে এজন্য করা হলো যে, যাকাত দিলে সম্পদ কমে না, প্রকারান্তরে বৃদ্ধি পায়৷ বারাকাত লাভ হয়৷ যাকে যাকাত দেয়া হলো, তারও মাল বৃদ্ধি পেলো৷ অথবা বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, যাকাত দাতার সওয়াব বৃদ্ধি পাওয়া৷ তাছাড়া যাকাত ও সাদাকা জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে ও হকদারগণকে ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী বানায়। এর ফলে সম্পদ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এর বিপরীত সুদ৷ মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখে৷ মানুষের কষ্ট ও অভিশাপের কারণ হয়৷ একসময় এই সম্পদ বিলুপ্ত হয়ে যায়৷ পরকালীন শাস্তি তো আছেই৷

    তাই তো আল্লাহ তাআলা বলেন-

    ﻳَﻤْﺤَﻖُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺍﻟﺮِّﺑَﺎ ﻭَﻳُﺮْﺑِﻲ ﺍﻟﺼَّﺪَﻗَﺎﺕِ.

    অর্থ: আল্লাহ তাআলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। (সূরা বাকারা: ২৭৬)

    وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ ۖ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ

    অর্থ: তােমরা যে সুদ দাও, যাতে তা মানুষের সম্পদে (যুক্ত হয়ে) বৃদ্ধি পায়, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে তােমরা যে যাকাত দিয়ে থাক, তাে যারা তা দেয় তারাই (নিজেদের সম্পদ) কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে নেয়। (সূরা রুম: ৩৯)

    যাকাতের আরেক অর্থ পবিত্র হওয়া বা পবিত্র করা৷ যাকাতের নামকরণ ‘যাকাত’ বলে এজন্য করা হলো যে, যাকাত দিলে সম্পদ পবিত্র হয়৷ অর্থাৎ ধনীর সম্পদে গরীবের যে একটি নির্ধারিত অংশ পাওনা রয়েছে, সেই অংশ আদায়ের পর মূল সম্পদ স্বচ্ছ হবে, নির্ভেজাল হবে৷ অথবা পবিত্র হওয়ার অর্থ হচ্ছে, যাকাত আদায়কারীর অন্তর পবিত্র হওয়া৷ আত্মা বিশুদ্ধ হওয়া৷ কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
    ﺧُﺬْ ﻣِﻦْ ﺃَﻣْﻮَﺍﻟِﻬِﻢْ ﺻَﺪَﻗَﺔً ﺗُﻄَﻬِّﺮُﻫُﻢْ ﻭَﺗُﺰَﻛِّﻴﻬِﻢ ﺑِﻬَﺎ.

    অর্থ: তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও, এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। (সূরা তাওবা : ১০৩)

    রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

    إِنَّ اللَّهَ لَمْ يَفْرِضِ الزَّكَاةَ، إِلَّا لِيُطَيِّبَ مَا بَقِيَ مِنْ أَمْوَالِكُمْ

    অর্থ: আল্লাহ তাআলা অবশিষ্ট মাল পবিত্র করার ব্যবস্থা স্বরূপ তোমাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন। (আবু দাউদ হাদীস নং-১৬৬৪, হাকিম হাদীস নং-১৪৮৭, সনদ সহীহ)

    ধনীর সম্পদে রয়েছে গরীবের হক, সেই হক আদায়ের নির্দেশ আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন-

    وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَعْلُومٌ. لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ.

    অর্থ: এবং যাদের অর্থ-সম্পদে নির্ধারিত হক আছে৷ যাচক ও বঞ্চিতের। (সূরা মা’আরিজ: ২৪-২৫)

    হাদীসে এসেছে-

    أنَّ الله قد افترض عليهم صدقةً في أموالهم, تُؤْخَذ من أغنيائهم فترد علي فقرائهم
    অর্থ: আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পদে সাদাকা (যাকাত) ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে আর দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা হবে৷ (সহীহ বুখারী হাদীস নং-১৩৯৫, সহীহ মুসলিম হাদীস নং-১৯)

    যাকাতের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, সম্পদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ নির্দিষ্ট মানুষকে তার মালিকানায় দিয়ে দেয়া৷

    অর্থনীতিতে যাকাতের ভূমিকা

    যাকাত গরীবের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে৷ ফলে বাজারে চাহিদা বাড়ে৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে যোগান সৃষ্টিতে চাপ প্রয়োগ হয়৷ বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে৷ নির্মাণ করা হয় নতুন নতুন কলকারখানা৷ কর্মসংস্থান হয় অসংখ্য শ্রমিকের৷ যারা সমাজের কাছে ছিন্নমূল, বেকার৷ কর্মসংস্থান করে তারা স্বাবলম্বী হয়৷ বিনিয়োগ বাড়ার কারণে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়, মুনাফা বৃদ্ধি পায়৷ ফলে যাকাত আদায়ের মতো ধনী লোকের সংখ্যাও বাড়ে৷ এভাবেই অর্থনীতিতে যাকাত অন্যতম চালিকা শক্তির ভূমিকা রাখতে পারে৷৷ তবে জরুরি হলো, যাকাত সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা৷ ধনীদের কাছ থেকে যাকাত উসুল নিশ্চিত করা৷ গরীবদের পর্যন্ত পৌঁছা নিশ্চিত করা৷

    যাকাত প্রদানের ফযীলত:

    সফলকাম মুমিনের বৈশিষ্টের অংশ হিসেবে আল্লাহ তাআলা যাকাত প্রদানকারীর বিষয়টি এনেছেন৷ ইরশাদ হচ্ছে-

    ﻗَﺪْ ﺃَﻓْﻠَﺢَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨُﻮﻥَ. ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻫُﻢْ ﻓِﻲ ﺻَﻼﺗِﻬِﻢْ ﺧَﺎﺷِﻌُﻮﻥَ. ﻭَﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻫُﻢْ ﻋَﻦْ ﺍﻟﻠَّﻐْﻮِ ﻣُﻌْﺮِﺿُﻮﻥَ. ﻭَﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻫُﻢْ ﻟِﻠﺰَّﻛَﺎﺓِ ﻓَﺎﻋِﻠُﻮﻥَ.

    অর্থ: মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে৷ যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র৷ যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত৷ যারা যাকাত দান করে থাকে৷ (সুরা মুমিনুন: ১-৪)

    কুরআনে আল্লাহ তাআলা হেদায়াতপ্রাপ্ত মুত্তাকীদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন-

    ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳُﺆْﻣِﻨُﻮﻥَ ﺑِﺎﻟْﻐَﻴْﺐِ ﻭَﻳُﻘِﻴﻤُﻮﻥَ ﺍﻟﺼَّﻼﺓَ ﻭَﻣِﻤَّﺎ ﺭَﺯَﻗْﻨَﺎﻫُﻢْ ﻳُﻨﻔِﻘُﻮﻥَ.

    অর্থ: আর আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় (যাকাত প্রদান) করে। (সুরা বাকারা: ৪)

    যাকাত আদায়কারীর জন্য মহা পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে৷ ইরশাদ হচ্ছে-

    وَالْمُقِيْمِيْنَ الصَّلاَةَ وَالْمُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَالْمُؤْمِنُوْنَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أُوْلَـئِكَ سَنُؤْتِيْهِمْ أَجْراً عَظِيْماً
    অর্থ: যারা সালাত কায়েমকারী, যাকাতদাতা এবং আল্লাহ ও আখিরাত দিবসে বিশ্বাসী। এরাই তারা, যাদেরকে আমি মহা প্রতিদান দেব। (সূরা নিসা: ১৬২)

    মুআয বিন জাবাল রাযি. আরয করলেন হে আল্লাহর রাসূল!

    ﺃَﺧْﺒِﺮْﻧِﻲ ﺑِﻌَﻤَﻞٍ ﻳُﺪْﺧِﻠُﻨِﻲ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔَ ﻭَﻳُﺒَﺎﻋِﺪُﻧِﻲ ﻋَﻦِ ﺍﻟﻨَّﺎﺭِ ﻗَﺎﻝَ ﻟَﻘَﺪْ ﺳَﺄَﻟْﺘَﻨِﻲ ﻋَﻦْ ﻋَﻈِﻴﻢٍ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﻴَﺴِﻴﺮٌ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﻦْ ﻳَﺴَّﺮَﻩُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺗَﻌْﺒُﺪُ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﻟَﺎ ﺗُﺸْﺮِﻙْ ﺑِﻪِ ﺷَﻴْﺌًﺎ ﻭَﺗُﻘِﻴﻢُ ﺍﻟﺼَّﻠَﺎﺓَ ﻭَﺗُﺆْﺗِﻲ ﺍﻟﺰَّﻛَﺎﺓَ ﻭَﺗَﺼُﻮﻡُ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ ﻭَﺗَﺤُﺞُّ ﺍﻟْﺒَﻴْﺖَ

    অর্থ: আমাকে এমন একটি আমাল সম্পর্কে বলুন, যেটি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখতে পারবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: তুমি এক মহান বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে৷ তবে আল্লাহ যার জন্য সহজ করে দেন বিষয়টি তার জন্য খুবই সহজ। তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, সালাত কায়িম করবে, যাকাত দেবে, রামাযান মাসের রোযা পালন করবে এবং বায়তুল্লাহর হজ্ব আদায় করবে। (তিরমিযী হাদীস নং-২৬১৬)

    অপর হাদীসে এসেছে-

    مَا مِنْ عَبْدٍ يُصَلِّي الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ وَيَصُومُ رَمَضَانَ وَيُخْرِجُ الزَّكَاةَ وَيَجْتَنِبُ الْكَبَائِرَ السَّبْعَ إِلَّا فُتِّحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَقِيلَ لَهُ ادْخُلْ بِسَلَامٍ

    অর্থ: যে বান্দা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রামাযান মাসে সাওম পালন করে, যাকাত প্ৰদান করে এবং সাতটি কবিরা গুনাহ পরিত্যাগ করে থাকে, অবশ্যই তার জন্য জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে এবং তাকে বলা হবে যে, তুমি প্রশান্ত চিত্তে জান্নাতে প্রবেশ কর। (নাসাঈ হাদীস নং-২৪৪০)

    উল্লেখ্য, হাদীসে বর্ণিত সাতটি কবিরা গোনাহ হচ্ছে-

    ১. আল্লাহর সাথে শরীক করা৷ ২. জাদু করা৷ ৩. ইসলামী ও রাষ্ট্রীয় আইনী ব্যবস্থা ব্যতীত যথার্থ কারণ ছাড়া অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা৷ ৪. সুদ খাওয়া, সুদ প্রদান করা৷ ৫. ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করা৷ ৬. জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা। ৭. সতী-সাধ্বী ও সরলমনা নারীদের প্রতি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয়া। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-৬৮৫৭, সহীহ মুসলিম হাদীস নং-১৬৪)

    কিয়ামতের দিন সাদাকা ছায়া দিবে

    উকবা ইবনু আমির রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

    كُلُّ امْرِئٍ فِي ظِلِّ صَدَقَتِهِ حَتَّى يُفْصَلَ بَيْنَ النَّاسِ

    অর্থ: বিচার কাজ সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক মানুষ (কিয়ামতের দিন) তার সাদাকার ছায়ায় থাকবে৷ (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং-১৭৩৩৩, সহীহ ইবনু হিব্বান হাদীস নং-৩৩১০, সনদ সহীহ)

    যাকাত আদায়ের ইহকালীন উপকার-

    যাকাতের দ্বারা সম্পদের সুরক্ষা হয়

    যাকাত আমাদের সম্পদ সুরক্ষার প্রধানতম উপায়৷ যাকাত প্রদান করলে চুরি-ডাকাতি থেকে, সব রকমের ক্ষতিগ্রস্ততা ও নষ্ট হওয়া থেকে সম্পদ রক্ষা পায়৷ হাদীসে এসেছে-

    ﻋَﻦْ ﺟَﺎﺑِﺮٍ ﻗَﺎﻝَ: ﻗَﺎﻝَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲُّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ: ﺇِﺫَﺍ ﺃَﺩَّﻳْﺖَ ﺯَﻛَﺎﺓَ ﻣَﺎﻟِﻚَ، ﻓَﻘَﺪْ ﺃَﺫْﻫَﺒْﺖَ ﻋَﻨْﻚَ ﺷَﺮَّﻩُ.

    অর্থ: জাবির রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূল ﷺ বলেছেন- তুমি যখন তোমার সম্পদের যাকাত আদায় করবে, তখন এর অনিষ্ট থেকে তুমি রক্ষা পেয়ে যাবে। (মুস্তাদরাকে হাকিম হাদীস নং-১৪৩৯, ইবনু খুযাইমাহ হাদীস নং-২২৫৮)

    যাকাতের মাধ্যমে আরোগ্য নসীব হয়

    রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

    دَاوُوْا مَرْضَاكُمْ بِالصَّدَقَةِ، وَحَصِِّنُوْا أَمْوَالَكُمْ بِالزَّكَاةِ، وَأَعِدُّوْا لِلْبَلاَءِ الدُّعَاءَ-

    অর্থ: সাদাকার মাধ্যমে তোমাদের পীড়ার চিকিৎসা কর, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তোমাদের সম্পদকে সুরক্ষিত কর এবং দুআর মাধ্যমে বালা-মুসীবত থেকে বাঁচার প্রস্তুতি গ্রহণ কর। (বাইহাকী হাদীস নং-৬২১৩)

    অপমৃত্যু রোধ হয়

    যাকাত-সাদাকার কারণে আল্লাহ তাআলা অপমৃত্যু থেকে হেফাজত করেন৷

    হযরত আনাস রাযি. বলেন: রাসূল ﷺ ইরশাদ করেছেন-

    الصَّدَقَةُ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، وَتَدْفَعُ مِيتَةَ السُّوءِ.

    অর্থ: সাদাকা আল্লাহর ক্রোধ নির্বাপিত করে এবং অসুন্দর মৃত্যু থেকে হেফাজত করে। (তিরমিযী হাদীস নং-৬৬৪, সহীহ ইবনু হিব্বান হাদীস নং-৩৩০৯)

    যাকাত না দেওয়ার ইহকালীন ক্ষতি

    যাকাত না দিলে সম্পদ ধ্বংস বা বরকতশূন্য হয়ে যায়৷ হাদীসে এসেছে-

    مَا تَلَفَ مَالٌ فِي بَرٍّ وَلا بَحْرٍ إِلا بِمَنْعِ الزَّكَاةِ
    অর্থ: জলে-স্থলে যেখানেই কোন সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংস হয়, তা কেবল মালের যাকাত দেয়া বন্ধ করার কারণেই। (মাজমাউয যাওয়াইদ: ৩/৬৩)

    যাকাত না দিলে সমাজে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়৷ হাদীসে এসেছে-

    ما منَعَ قومٌ الزكاة، إلا ابتلاهم الله بالسنين

    অর্থ: কোন সম্প্রদায় যখন যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, আল্লাহ তাআলা তখন তাদেরকে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করেন। (তাবারানী আওসাত হাদীস নং-৪৫৭৭, আত-তারগীর ওয়াত-তারহীব হাদীস নং-১১৪৫)

    যাকাত অনাদায়ীর পরকালীন শাস্তি

    যারা যাকাত আদায় করবে না, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাদের জন্য বিভীষিকাময় শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন৷ ইরশাদ হচ্ছে-

    ﻭَﻟَﺎ ﻳَﺤْﺴَﺒَﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳَﺒْﺨَﻠُﻮﻥَ ﺑِﻤَﺎ ﺁَﺗَﺎﻫُﻢُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻓَﻀْﻠِﻪِ ﻫُﻮَ ﺧَﻴْﺮًﺍ ﻟَﻬُﻢْ ﺑَﻞْ ﻫُﻮَ ﺷَﺮٌّ ﻟَﻬُﻢْ ﺳَﻴُﻄَﻮَّﻗُﻮﻥَ ﻣَﺎ ﺑَﺨِﻠُﻮﺍ ﺑِﻪِ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ
    অর্থ: আর আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করে, তাদের ধারণা করা উচিৎ নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং উহা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে৷ অচিরেই কিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে পরানো হবে। (সুরা আলে ইমরান: ১৮০)

    অপর জায়গায় ইরশাদ হচ্ছে-

    ﻭَﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳَﻜْﻨِﺰُﻭﻥَ ﺍﻟﺬَّﻫَﺐَ ﻭَﺍﻟْﻔِﻀَّﺔَ ﻭَﻟَﺎ ﻳُﻨْﻔِﻘُﻮﻧَﻬَﺎ ﻓِﻲ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﺒَﺸِّﺮْﻫُﻢْ ﺑِﻌَﺬَﺍﺏٍ ﺃَﻟِﻴﻢٍ ﻳَﻮْﻡَ ﻳُﺤْﻤَﻰ ﻋَﻠَﻴْﻬَﺎ ﻓِﻲ ﻧَﺎﺭِ ﺟَﻬَﻨَّﻢَ ﻓَﺘُﻜْﻮَﻯ ﺑِﻬَﺎ ﺟِﺒَﺎﻫُﻬُﻢْ ﻭَﺟُﻨُﻮﺑُﻬُﻢْ ﻭَﻇُﻬُﻮﺭُﻫُﻢْ ﻫَﺬَﺍ ﻣَﺎ ﻛَﻨَﺰْﺗُﻢْ ﻟِﺄَﻧْﻔُﺴِﻜُﻢْ ﻓَﺬُﻭﻗُﻮﺍ ﻣَﺎ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺗَﻜْﻨِﺰُﻭﻥَ

    অর্থ: আর যারা সোনা-রোপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যায় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন (কিয়ামতের দিন) জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্টদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে) এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার। (সূরা তাওবাহ: ৩৪-৩৫)

    যে সম্পদশালী যাকাত দেয় না তার মর্মন্তুদ পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন-

    ﻣَﻦْ ﺁﺗَﺎﻩُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻣَﺎﻟًﺎ، ﻓَﻠَﻢْ ﻳُﺆَﺩِّ ﺯَﻛَﺎﺗَﻪُ ﻣُﺜِّﻞَ ﻟَﻪُ ﻣَﺎﻟُﻪُ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﺷُﺠَﺎﻋًﺎ ﺃَﻗْﺮَﻉَ ﻟَﻪُ ﺯَﺑِﻴﺒَﺘَﺎﻥِ ﻳُﻄَﻮَّﻗُﻪُ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ، ﺛُﻢَّ ﻳَﺄْﺧُﺬُ ﺑِﻠِﻬْﺰِﻣَﺘَﻴْﻪِ – ﻳَﻌْﻨِﻲ ﺑِﺸِﺪْﻗَﻴْﻪِ – ﺛُﻢَّ ﻳَﻘُﻮﻝُ ﺃَﻧَﺎ ﻣَﺎﻟُﻚَ ﺃَﻧَﺎ ﻛَﻨْﺰُﻙَ، ﺛُﻢَّ ﺗَﻼَ: ﻟَﺎ ﻳَﺤْﺴِﺒَﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳَﺒْﺨَﻠُﻮﻥَ ﺍﻵﻳَﺔَ.

    অর্থ: যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, সে তার যাকাত আদায় করল না, তার সম্পদকে তার জন্যে বিষধর সাপে রূপান্তরিত করা হবে। সাপটার চোখের উপর থাকবে দুটি কালো বিন্দু। কেয়ামত দিবসে সাপটি তার গলা পেঁচিয়ে ধরবে। তারপর দুই চোয়ালে তাকে চেপে ধরে বলতে থাকবে- আমি তোমার সম্পদ। আমি তোমার সঞ্চিত ধনভাণ্ডার। তারপর রাসূলে কারীম ﷺ এই আয়াত তিলাওয়াত করেন-

    وَلَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ ؕ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ؕ سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَة
    অর্থ: আর আল্লাহ যাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর। বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর, যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল৷ কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে৷ আর আসমানসমূহ ও জমিনের উত্তরাধিকার আল্লাহরই জন্য। আর তোমরা যা আমল কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত। সূরা আলে ইমরান: ১৮০ (বুখারী হাদীস নং-১৩৩৮)

    যাকাত আদায়ের আবশ্যকতা

    যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারে এত অধিক পরিমাণে দলীল বিদ্যমান যে, এ বিষয়ের জন্য স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করা সম্ভব৷ এখানে আমরা শুধু কুরআন ও হাদীস থেকে একটা করে দলীল আলোচনা করছি-

    وَاَقِیْمُوا الصَّلٰوة وَ اٰتُوا الزَّکٰوة وَ ارْکَعُوْا مَعَ الرّٰکِعِیْن

    অর্থ: এবং তােমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর ও রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।(সূরা বাকারা: ৪৩)

    ইবনু উমার রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন-

    بنُيَ الإسْلامُ على خمَسْ:ٍ شهَادةِ أنَّ لا إلَه إلَّا اللهُ وأنَّ مُحمَّداً رَسُولُ الله، وإِقَامِ الصَّلاةِ، وإيتَاءِ الزَّكَاة، والحجِّ وَصَومِ رَمَضَانَ

    অর্থ: ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বস্তুর ওপর রাখা হয়েছে, সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, এবং মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্ব সম্পাদন করা ও রামাযানের রোযা পালন করা।(বুখারি হাদীস নং-৮ মুসলিম হাদীস নং-১৬)

    প্রশ্ন: যাকাত কখন ফরয হয়? এবং কার উপর ফরয হয়?

    উত্তর: সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, স্বাধীন, মুসলিম নরনারী, যার মালিকানায় ঋণ ব্যতীত নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত, নেসাব পরিমাণ বর্ধনশীল সম্পদ থাকবে এবং সে সম্পদের উপর পূর্ণ এক চন্দ্রবছর অতিবাহিত হবে, তার উপর যাকাত আদায় করা ফরয৷ (আহকামে যাকাত পৃষ্ঠা: ৩৭)

    যাকাত আদায় করতে হবে চান্দ্রবর্ষ তথা হিজরী বর্ষের আলোকে

    চন্দ্রবর্ষের হিসাবে যাকাত আদায় করা হবে৷ সৌরবর্ষ তথা ঈসায়ী সন অনুসারে নয়৷ চন্দ্রবর্ষের হিসাবে যেদিন সম্পদের বছর পুরা হবো, সেদিন যাকাত ফরয হয়েছে বলে ধর্তব্য হবে৷ কেননা চন্দ্রবর্ষের হিসাবে বছর হয় ৩৫৪ দিনে৷ আর সৌরবর্ষের হিসাবে বছর হয় ৩৬৫ দিনে৷ তাহলে দেখা যায় বছরান্তে ১০/১১ দিনের ব্যবধান হয়ে যায়৷ সৌরবর্ষের হিসাবে যাকাতের সময়কাল গণনা করলে বছরে ১০/১১ দিনের কম যাকাত আদায় হয়৷ যা একজন সাহেবে নেসাবের উপর অনাদায়ী থেকে যায়৷
    (আপকে মাসাইল আওর উনকা হল: ৩/৩৬২)

    নেসাবের পরিমাণ ও যাকাতযোগ্য সম্পদ:

    সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর যাকাত ফরয হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে যাকাত ফরয হয়।

    স্বর্ণের উপর যাকাত: হাদীসে বর্ণিত হিসাব অনুযায়ী ঋণ ও মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ২০ মিসকাল তথা সাড়ে সাত ভরি৷ আধুনিক হিসাবে ৮৭.৪৮ গ্রাম সোনা বা তার মূল্য৷ এগুলো অলংকার হোক বা কাঁচা সোনা হোক৷ ব্যবহারের থাকুক বা অব্যবহৃত থাকুক৷ (আবু দাউদ হাদীস নং-১৫৭৩)

    রোপার উপর যাকাত: রোপার নেসাব হলো, ২০০ দিরহাম তথা ৫২.৫ ভরি বা ৬১২.৩৬ গ্রাম বা তার সমমূল্য৷ কেউ এই পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে সে সাহিবে নেসাব বা নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-১৪৪৭; সহীহ মুসলিম হাদীস নং-৯৭৯)

    নগদ টাকার উপর যাকাত: যদি সাড়ে ৫২ ভরি রোপার মূল্য পরিমাণ নগদ টাকা, ব্যাংক ব্যালেন্স থাকে, যা তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়, তাহলে বছরান্তে সেই টাকা বা পণ্যের যাকাত আদায় করতে হবে৷ ঠিক তদ্রূপ হজ্বের উদ্দেশ্যে, ঘরবাড়ি নির্মাণ বা ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদিতে খরচের জন্য যে টাকা জমা রাখা হয়, এক হিজরী বছর অতিক্রান্ত হবার পর সেগুলোর উপরও যাকাত আসবে৷ (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক হাদীস নং-৭০৩২, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হাদীস নং-১০৩২৫)

    ব্যবসার পণ্য: ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যে সমস্ত ব্যবসার পণ্য থাকে, সবগুলোর মূল্য হিসাব করে নেসাব পরিমাণ হয়ে গেলে এক হিজরী বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যাকাত দিতে হবে৷

    হাদীসে এসেছে-

    لاَ زَكَاةَ فِيْ مَالٍ حَتَّى يَحُوْلَ عَلَيْهِ الْحَوْلُ-

    অর্থ: এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মালের যাকাত নেই। (তিরমিযী হাদীস নং-৬৩২, ইবনু মাজাহ হাদীস নং-১৭৯২, সনদ সহীহ)

    যে সব জিনিসের ওপর যাকাত ফরয নয়

    -নিজ ও পোষ্য পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর যাকাত ফরয নয়।

    -গৃহের আসবাবপত্র যেমন খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদি এবং গার্হস্থ সামগ্রী যেমন হাড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তা যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেন।

    তবে এক্ষেত্রে মনে রাখাতে হবে য, যেসব বস্ত্তর উপর যাকাত আসে না সেগুলোতে যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে তাহলে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে এই সংযুক্ত সোনা-রুপারও যাকাত ফরয হবে।

    -পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে যাকাত ফরয হবে না।

    -দোকান-পাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসাপণ্য নয়, তার ওপর যাকাত ফরয নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য তাই এসবের ওপর যাকাত ফরয হবে।

    -ঘর-বাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও যাকাত ফরয নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে, নেসাব পরিমাণ হলে সেগুলোর বছরান্তে যাকাত দিতে হবে৷ (যেসব জিনিসের উপর যাকাত ফরয নয়- এই আলোচনা মাসিক আল-কাউসার সেপ্টেম্বর ২০০৮ সংখ্যা থেকে নেওয়া হয়েছে৷)

    যাকাত আদায়ের হিসাব

    নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চন্দ্রবছর অতিক্রান্ত হলে প্রথমে অতিরিক্ত, যাকাত আদায়যোগ্য সমস্ত সম্পদের হিসাব কষে টাকার হিসাবে তার মূল্য কত আসে দেখতে হবে৷ সেখানে প্রাপ্য ঋণ যোগ হবে৷ প্রাপ্য ঋণের বেলায় যেগুলো সহসা আদায় হয়ে যাবে বা আদায় হওয়ার প্রবল আশা রয়েছে, সেগুলোই ধর্তব্য হবে৷ যে সমস্ত প্রাপ্য ঋণ শুধু কাগজে-কলমে আছে, কিন্তু আদায়ের আশা নেই, মার খাওয়ার উপক্রম, সেগুলো হিসাবে আসবে না৷ তবে এগুলো পাওয়ার পর যাকাত দিতে হবে৷

    প্রদেয় ঋণ বিয়োগ হবে৷ এ ক্ষেত্রে যে ঋণ কিস্তিতে আদায়যোগ্য, সেগুলোর পুরোটা বিয়োগ হবে না, বরং আগামি এক বছরে আদায়যোগ্য অংশই কেবল বাদ পড়বে৷ বাকিগুলো বিয়োগের হিসাবে আসবে না৷

    এখন যোগ-বিয়োগের হিসাব মিলিয়ে যত টাকা মূল্যের সম্পদ হবে, সেই সমুদয় সম্পদের শতকরা ২.৫০ পার্সেন্ট তথা সমুদয় সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত আদায় করতে হবে৷

    যাকাত হিসাব করার তারিখে যে পরিমাণ সম্পদ হাতে থাকে, তার উপরই যাকাত আসবে৷ মধ্যখানে সম্পদে কমবেশ হলে সেটা ধর্তব্য নয়৷

    মনে করুন, এক ব্যক্তির কাছে রামাযানের এক তারিখে ছিলো এক লাখ টাকা। পরবর্তী বছর প্রথম রামাযানে দুদিন পূর্বে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা তার হাতে এসে গেলো। এখন এই দেড় লাখ টাকার উপরই যাকাত ফরজ হবে। এটা বলা যাবে না, এ পঞ্চাশ হাজার টাকা এলো মাত্র দুদিন আগে। এ পঞ্চাশ হাজার টাকা তো এক বছর ব্যাপী ছিল না। সুতরাং এর উপর যাকাত হবে না। বরং যাকাত হিসাব করার তারিখে যত সম্পদ আপনার মালিকানায় থাকবে এর থেকেই যাকাতের পূর্ববর্তী রামাযানের প্রথম তারিখ থেকে পরিমাণে কম হোক বা বেশি হোক।

    ডায়মন্ডের উপর যাকাত আসে না

    যাকাতের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, যা সর্বসাধারণের কাছে থাকে বা ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর উপর যাকাত আসে৷ ভিআইপিরা যেগুলো ব্যবহার করে, জনসাধারণের হাতে যেগুলো সাধারণত আসে না, সেগুলোর উপর যাকাত আসে না৷ সোনা-রোপা একসময় মানুষ কারেন্সি হিসেবে ব্যবহার করত, তাছাড়া এগুলো বর্ধনশীল সম্পদ, তাই এগুলোকে যাকাতের মৌলিক ধাতু হিসাবে গণ্য করা হয়৷ এগুলো একসময় সকল সাধারণ মানুষের কাছে ছিলো৷ এখনো টাকা হিসেবে আছে, যার মৌলিকত্ব বা উদ্গত সোনা-রোপা থেকেই৷

    لا زكاة في اللآلئ والجواهر إلا أن يكون التجارة

    অর্থ: ডায়মন্ড, হীরা-জাওহারের উপর যাকাত আসে না৷ তবে ব্যবসার জন্য হলে (ব্যবসার পণ্য হিসেবে যাকাত আসবে)৷ (আদ্দুররুল মুখতার: ৩/১৯৪)

    মিশ্রিত সম্পদের উপর যাকাত

    যদি কারো কাছে কিছু রূপা আর সামান্য স্বর্ণ থাকে, (এককভাবে কোনো একটি দ্বারা নেসাব পূর্ণ হয় না) অথবা সাথে কিছু মুদ্রাও থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে রূপার নেসাবই বিবেচ্য হবে৷ বাজারে রূপার মূল্য দেখে তা কাগজে লিখুন, স্বর্ণের দাম জিজ্ঞাসা করে তাও লিখুন, তার সাথে যোগ করুন নগদ মুদ্রার পরিমাণ যদি থাকে৷ এ তিনটির সমষ্টির মূল্য যদি রূপার নেসাবের (৬১২.৩৬ গ্রাম) মূল্য পরিমাণ হয়, তাহলে যাকাত ফরয হবে, অন্যথায় নয়৷ মোটকথা মিশ্রিত সম্পদের ক্ষেত্রে মানদণ্ড হবে রূপার নেসাব, স্বর্ণের নেসাব নয়৷ কারণ এটাই দরিদ্র মানুষের অনুকূলে৷ (আদ্দুররুল মুখতার: ৩/২২৯, আহকামে যাকাত পৃষ্ঠা: ৪৪)

    (و) يضم (الذهب إلى الفضة) وعكسه بجامع الثمنية (قيمة)
    অর্থ: স্বর্ণকে রূপার সাথে, অথবা রূপাকে স্বর্ণের সাথে মিলিয়ে তার মূল্য ধর্তব্য হবে৷ (রদ্দুল মুহতার: ২/৩০৩)

    রূপার মূল্যের উপর যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্য ধর্তব্য হবে৷ অর্থাৎ এই মুহূর্তে আপনার কাছে যে পরিমাণ সম্পদ আছে, সে সম্পদ দ্বারা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা ক্রয় করতে পারবেন, এই পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার উপর যাকাত ওয়াজিব৷

    মিশ্রিত সম্পদে যাকাত আদায়ে মূল্যের মানদণ্ড সোনা নাকি রূপা?

    যাকাতের নেসাবের যে কয়েকটা বস্তু শরীয়ত ঠিক করে দিয়েছে, তন্মধ্যে মৌলিকভাবে সোনা-রোপা হচ্ছে আসল মাপকাঠি৷ যদিও গবাদি পশু ও ফসলের যাকাতের হিসাব ভিন্ন৷ তৎকালীন যুগে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণের যে দাম ছিলো, সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপারও সমান দাম ছিলো৷ কিন্তু এখন তো দামের কী আকাশ-পাতাল পার্থক্য! তাহলে কোনটিকে আসল মাপকাঠি ধরা হবে? এটা বর্তমান সময়ে বহুল চর্চিত একটি প্রশ্ন বা বিষয়৷ কেউ কেউ তো রূপার দাম কম হওয়ার কারণে স্বর্ণকে মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করে নিয়েছেন৷

    এখন আসি পর্যালোচনায়- মিশ্রিত সম্পদে যাকাতের নেসাবের মূল মাপকাঠি সোনা-রোপার মধ্যে যদি আপনি শুধু স্বর্ণকে নেসাব হিসেবে ধরেন, তাহলে শরীয়তের দুটি বিষয় এখানে সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে৷

    এক. সুস্পষ্ট নস তথা কুরআন-হাদীস কর্তৃক নির্ধারিত দুটি নেসাবের একটিকে অর্থাৎ রোপাকে একেবারে পরিত্যাগ করা হয়ে যাচ্ছে৷ কারণ নেসাবে স্বর্ণকে মাপকাঠি ধরলে রৌপ্যকে একেবারে পরিত্যাগ করা হয়ে যায়৷ আর শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত নেসাবের একটিকে এভাবে পরিত্যাগ করা মোটেও ঠিক হবে না৷ অপরদিকে রোপাকে নেসাবে যাকাতের মাপকাঠি ধরলে সোনার ব্যাপারটি পরিত্যাগ করা হয় না৷ বরং সোনার নেসাব তার জায়গামতো ঠিক থাকে৷

    দুই. যাকাতের মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্যতম হচ্ছে, গরীবের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া৷ আর সেটা রোপার মূল্য ধরে দিলে যথাযথভাবে সংরক্ষণ হয়৷ কারণ মিশ্র সম্পদে যদি রূপার মূল্য ধরে যাকাতের নেসাব হিসাব করেন, তাহলে যে সব ব্যক্তির উপর যাকাত ফরয হবে, সোনার মূল্য ধরে হিসাব করলে তাদের উপর যাকাত ফরয হবে না৷ তাহলে মিক্স সম্পদে স্বর্ণকে মাপকাঠি বানালে অধিক পরিমাণে গরীব বঞ্চিত হবে৷

    দেখুন, ইমাম সারখাসী রাহ. মাবসুত কিতাবে লিখেন-
    ألا تری أنه لوکان یتقومه بأحد النقدین یتم النصاب وبالآخر لا یتم فإنه یقوم بما یتم به النصاب لمنفعة الفقراء۔
    অর্থ: দেখো না দুটি মুদ্রার একটির মূল্য ধরে হিসাব করলে (যাকাতের) নেসাব পুরা হয়ে যায়৷ অপরটি ধরে হিসাব করলে পুরা হয় না৷ তাহলে যেটির দ্বারা নেসাব পুরা হয়, সেটি ধরে যাকাত দিতে হবে গরীবের উপকারের দিকটি প্রাধান্য দিয়ে৷ (মাবসূত সারখাসী: ২/১৯১)

    তাই এখনো পর্যন্ত রূপার মূল্য ধরেই মিশ্রিত সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে৷

    ব্যবহৃত সোনা-রোপার উপর যাকাতের বিধান

    একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার যাকাত দিতে হয়।

    এক মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে রাসূল ﷺ-এর কাছে আসেন। মেয়েটির হাতে দুটি স্বর্ণের চুড়ি ছিল। রাসূল ﷺ বললেন, তুমি এ অলংকারের যাকাত আদায় কর? মহিলা বললেন, না। রাসূল ﷺ বললেন-
    أَيَسُرّكِ أَنْ يُسَوِّرَكِ اللهُ بِهِمَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ سِوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ؟
    অর্থ: তুমি কি পছন্দ কর যে, এ দুটি চুড়ির বদলে তোমাকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন আগুনের দুটো চুড়ি পরাবেন?
    (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৫৬৩, নাসবুর রায়াহ: ২/৩৭০, সনদ সহীহ)

    এই বর্ণনাসহ আরো অনেকগুলো হাদীস ও আসারের আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন যে, ব্যবহৃত স্বর্ণেরও যাকাত ওয়াজিব৷

    ফিক্সড ডিপোজিটের উপর যাকাতের বিধান

    প্রচলিত সুদী ব্যাংকিং সিস্টেমে ফিক্সড ডিপোজিট করা নাজায়েয৷ এখান থেকে যা লভ্যাংশ আসবে, সবগুলোই সুদ হিসেবে গণ্য হবে৷ তবে ফিক্সড ডিপোজিট বা ডিপিএস করে যে মূলধন ব্যাংকে রাখা হয়, সেগুলোর উপর বছরান্তে যাকাত আসবে৷ প্রতি বছরই মূলধনের যাকাত দিতে হবে৷ পেছনের বছরগুলোতে যাকাত না দিয়ে থাকলে সকল বছরের যাকাত একসাথে দিতে হবে৷ (কিতাবুন নাওয়াযিল: ৬/৪৭১)

    প্রভিডেন্ট ফান্ডের যাকাতের বিধান

    প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার উপর কর্মচারী/কর্মকর্তার কব্জা হওয়ার পর যাকাত ওয়াজিব হয়৷ এর পূর্বে তাতে যাকাত ওয়াজিব নয়৷ এবং হাতে আসার পরও বিগত বছরগুলোর যাকাত ওয়াজিব নয়৷ বরং ঐ বছরের যাকাতই ওয়াজিব হবে, যে বছর উক্ত টাকা হাতে এসেছে৷ (ফাতাওয়ায়ে উসমানী: ৩/৪৮)

    মোহরানার টাকার উপর যাকাতের বিধান

    মোহরের টাকা পরিশোধ করে স্ত্রীকে হস্তগত করার আগ পর্যন্ত উক্ত সম্পদে স্ত্রীর মালিকানা সাব্যস্ত হয় না। তাই স্বামীর হাতে গচ্ছিত মোহরানার টাকার উপর যাকাত আবশ্যক হয় না। (রদ্দুল মুহতার: ২/৩০৬)

    ফসলের যাকাত:

    জমিতে উৎপাদিত সব রকমের ফসলের উপর যাকাত আসবে৷ কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনে ফসলের হক আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন৷

    ফসলের যাকাত আদায় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে নির্দেশনা দিচ্ছেন-

    يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ ۖ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ

    অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় কর৷ (সূরা বাকারা: ২৬৭)

    অপর জায়গায় ইরশাদ হচ্ছে-

    كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآَتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ

    অর্থ: তোমরা জমিনের ফসল খাও যখন ফসল ফলে, আর ফসল কাটার সময় ফসলের হক আদায় কর। তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আনআম: ১৪১)

    وقوله تعالى: يا أيها الذين آمنوا أنفقوا من طيبات ما كسبتم ومما أخرجنا لكم من الأرض. وفي الآية دلالة على أن للفقراء حقا في المخرج من الأرض حيث أضاف المخرج إلى الكل فدل على أن للفقراء في ذلك حقا كما أن للأغنياء فيدل على كون العشر حق الفقراء (بدائع الصنائع:2/17)

    অর্থাৎ, আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে জমিনে উৎপাদিত ফসলে গরীবের হক আছে। এমনকি পূর্ণ উৎপাদনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুতরাং বুঝা গেল এতে ধনীদের মতো গরীবদেরও হক আছে। তাই এ কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, উশর (যা ফসলের যাকাতের নির্ধারিত পরিমাণ) গরীবদের জন্য। (বাদায়েউস সানায়ে: ২/১৭)

    হাদীস শরীফে এসেছে-

    عن سالم بن عبد الله عن أبيه رضي الله عنه: عن النبي صلى الله عليه و سلم قال: فيما سقت السماء والعيون أو كان عثريا العشر وما سقي بالنضح نصف العشر.

    অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজী ﷺ বলেন, আসমানী বা নদীনালা অথবা অন্যান্য প্রাকৃতিক পানি সিঞ্চনে যা উৎপাদিত হয় তাতে ওশর আসবে। আর যা কৃত্রিম উপায়ের পানি দ্বারা সিঞ্চিত হবে তাতে অর্ধেক ওশর ওয়াজিব হবে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-১৪৫৩)

    উশর বলা হয় উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশকে৷ আর খারাজ বলা হয় ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগকে৷

    বাংলাদেশের জমিন উশরী নাকি খারাজি? এ ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত থাকলেও অগ্রাধিকারযোগ্য মত হচ্ছে, এ দেশের অধিকাংশ জমিন উশরী৷ ভিন্নমত থাকলেও এটাই সতর্কতার দাবি৷

    যাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে

    কুরআন মজীদে যাকাতের খাত নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। এ খাত ছাড়া অন্য কোথাও যাকাত প্রদান করা জায়েয নয়। ইরশাদ হয়েছে-

    ﺍِﻧَّﻤَﺎ ﺍﻟﺼَّﺪَﻗٰﺖُ ﻟِﻠْﻔُﻘَﺮَﺁﺀِ ﻭَ ﺍﻟْﻤَﺴٰﻜِﯿْﻦِ ﻭَ ﺍﻟْﻌٰﻤِﻠِﯿْﻦَ ﻋَﻠَﯿْﻬَﺎ ﻭَ ﺍﻟْﻤُﺆَﻟَّﻔَﺔِ ﻗُﻠُﻮْﺑُﻬُﻢْ ﻭَ ﻓِﯽ ﺍﻟﺮِّﻗَﺎﺏِ ﻭَ ﺍﻟْﻐٰﺮِﻣِﯿْﻦَ ﻭَ ﻓِﯽْ ﺳَﺒِﯿْﻞِ ﺍﻟﻠّٰﻪِ ﻭَ ﺍﺑْﻦِ ﺍﻟﺴَّﺒِﯿْﻞِ ؕ ﻓَﺮِﯾْﻀَﺔً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠّٰﻪِ ؕ ﻭَ ﺍﻟﻠّٰﻪُ ﻋَﻠِﯿْﻢٌ ﺣَﻜِﯿْﻢٌ

    অর্থ: যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা : ৬০)

    এই ৮ প্রকার ব্যক্তিকে যাকাত দেয়ার কথা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-

    ১- গরীব। যার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই

    ২- মিসকিন। যার কাছে একদমই কোন সম্পদ নেই।

    ৩- ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য শরীয়ত নির্দিষ্ট যাকাত আদায়কারী কর্মকর্তা। এটা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা নিযুক্ত হতে হবে। (জাওয়াহিরুল ফিক্বহ: ৬/৬৯)

    ৪- অমুসলিমদের ইসলামের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য উৎসাহমূলক যাকাত প্রদান।

    এ বিধানটি রহিত হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে কোন অমুসলিম বা ধনী নওমুসলিমকে যাকাত প্রদান জায়েজ নয়। (হিদায়া-১/১৮৪, মাআরিফুল কুরআন-৪/১৭১, তাফসীরে মাযহারী-৪/২৩৫)

    ৫- দাসমুক্তির জন্য। যেহেতু বর্তমানে দাস-দাসীর প্রচলন নেই। তাই আপাতত এই খাতটি স্থগিত৷

    ৬- ঋণগ্রস্তের জন্য।

    ৭- ফী সাবিলিল্লাহ। তথা আল্লাহর রাস্তায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য। জিহাদরত মুজাহিদরা। তাদের জিহাদের অস্ত্র ও পাথেয় ক্রয় করার জন্য যাকাতের টাকা গ্রহণ করবে। কারো কারো মতে হজ্বের সফরে থাকা দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। আরো কিছু উলামায়ে কেরামের মতে ইলমে দ্বীন অর্জনরত দরিদ্র তালিবুল ইলমের জন্য। (আল-হিদায়া: ১/১৮৫, রূহুল মাআনী: ৬/৩১৩)

    ৮- সফররত ব্যক্তিকে। যার বাড়িতে টাকা পয়সা আছে ঠিক। কিন্তু সফর অবস্থায় নিঃস্ব৷ বাড়ি থেকে টাকা আনারও কোনো ব্যবস্থা নেই৷

    যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না

    যার উপর যাকাত ওয়াজিব, তিনি তার উসুল তথা উপরের আত্মীয় বাবার দিক থেকে হোক বা মায়ের দিক থেকে৷ যেমন, পিতা-দাদা, পর-দাদা প্রমুখ, দাদি, দাদির দাদি প্রমুখ। মা-নানী প্রমুখ। সেই সাথে ফুরু তথা নিচের দিকের ঔরসজাত আত্মীয় যেমন, ছেলে-মেয়ে, নাতি প্রমুখ। আর স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে না। এছাড়া বাকি আত্মীয়-স্বজনকে যাকাত দেয়া জায়েয আছে। (রদ্দুল মুহতার: ২/৩৪৬)

    অগ্রাধিকারযোগ্য মতে বনু হাশিম সায়্যিদকে যাকাত দেওয়া যাবে না৷ রাসূলুল্লাহ ﷺ নিষেধ করেছেন৷ (সহীহ মুসলিম: ২/২৭৯, রদ্দুল মুহতার: ২/৩৫০)

    যাকাত কোন খাতে দেওয়া উত্তম?

    দানের আরেকটি নিয়ম হলো নিজের নিকটাত্মীয়দের আগে দান করা। এতে একদিকে যেমন সদাকার সওয়াব পাওয়া যায়, একইসাথে আত্মীয়তার হকও আদায় হয়ে যায়। তাই রাসূল ﷺ এর প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং একে দ্বিগুণ সওয়াব লাভের মাধ্যম বলেছেন। তিনি বলেছেন-

    الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَهِيَ عَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ.

    অর্থ: মিসকীনকে দান করলে কেবল দান করার সওয়াব লাভ হয়। আর আত্মীয়-স্বজনকে দান করলে দুটি সওয়াব- দান করার সওয়াব এবং আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব। (তিরমিযী, হাদীস নং- ৬৫৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৬২৩৩)

    তবে হ্যাঁ, সবসময় অন্য সকল গরীব-দুঃখীদের এড়িয়ে কেবল নিকটজনদের দান করে যাব, এমন কথা নয়। কখনো হতে পারে নিকটাত্মীয়ের চেয়েও অন্যদের অভাব ও প্রয়োজনটা বেশি। দান করার সময় তাদের প্রতিও লক্ষ্য রাখা উচিত।

    যাকাত আদায় কি শুধু রামাযান মাসের বৈশিষ্ট্য?

    আমাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা আছে যে, সিয়াম পালন ছাড়াও রামাযান মনে হয় যাকাত আদায়েরও মাস৷ আসলে যাকাত আদায়ের নির্দিষ্ট কোনো মাস নেই৷ সম্পদশালী ব্যক্তির নেসাব পরিমাণ সম্পদ অর্জনের পূর্ণ এক বছর যেদিন পুরা হবে, সে দিনই ওই ব্যক্তির যাকাত আদায়ের দিবস৷ তবে বিশেষ কারণে যাকাত আদায় আগ-পিছ করা যায়৷

    যেমন কারো শাওয়াল মালে কিংবা শা’বান মাসে সম্পদের বছর পুরা হবে, সে যদি রামাযানে যাকাত আদায় করতে চায় আর একমাস অগ্রীম কিংবা একমাস পরে যাকাত আদায় করে, তাহলে তার যাকাত আদায় হয়ে যাবে৷ তবে রামাযানের অপেক্ষা না করে যাকাত আদায়ের নির্দিষ্ট তারিখ মতেই তা আদায় করে দেওয়া উচিত৷ কারণ নিজের স্বার্থের জন্য চাই তা দ্বীনি স্বার্থই হোক, গরীবের হক আটকে রাখা কোনোভাবেই সমীচীন নয়৷

    নফল সাদাকা

    নফল সাদাকা বলা হয়, যা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আদায় করা হয়, কিন্তু আদায় করা আবশ্যক নয়৷

    ফরয যাকাত আদায় করার পর নফল সাদাকা-খয়রাতের ফযীলত অপরিসীম৷ নফল সাদাকার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করা যায়৷ আল্লাহ তাআলা যে ৭ প্রকার মানুষকে কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ার নিচে স্থান করে দিবেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যারা গোপনে সাদাকা করে৷ ইরশাদ হচ্ছে-

    ورَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فأَخْفَاها، حتَّى لا تَعْلَمَ شِمالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينهُ
    অর্থ: এমন ব্যক্তি, যে এরূপ গোপনে দান করে যে, তার বাম হাত ডান হাতের দান সম্পর্কে অবগত হয় না। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-৬৮০৬, সহীহ মুসলিম হাদীস নং-১০৩১)

    রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-

    والصدقة تُطفِئُ الخَطيئة كما يُطفِئُ الماءُ النار.

    অর্থ: সাদাকা গোনাহ মিটিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুন নিভিয়ে দেয়। (তিরমিযী হাদীস নং-২৬১৬)

    إنَّ الصدقة لَتُطْفِئُ عن أهلها حَرّ القبور، وإنما يَسْتَظل المؤمن يوم القيامة في ظِلِّ صَدَقَتِه

    অর্থ: নিশ্চয় সাদাকা কবরের উত্তাপ থেকে তার বাসিন্দাকে মুক্তি দেয়। আর কিয়ামতের দিন মুমিন তার সদকার ছায়ার নিচে আশ্রয় নিবে৷ (তাবারানী হাদীস নং-৭৮৮)

    নফল সাদাকা সবাইকে দেয়া যাবে৷ বাবা-মা, স্বামী, স্ত্রী, বনু হাশিম সায়্যিদ, ধনী-গরীব, মুসলিম-অমুসলিম সবাইকে দেওয়া জায়েয৷ তবে প্রয়োজনগ্রস্থ আত্মীয়স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত৷

    و أما صدقة التطوع فيجوز صرفها إلى الغني؛ لأنها تجري مجرى الهبة
    অর্থ: নফল সাদাকা ধনীকে দেওয়া জায়েয আছে৷ কেননা নফল সাদাকা উপঢৌকনের অন্তর্ভুক্ত৷ (বাদায়েউস সানায়ে: ২/৪৭)

    রামাযানে সাদাকা করার ফযীলত

    রামাযান মাস তো সকল আমলেই সওয়াব বৃদ্ধির মাস৷ তাছাড়া রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর রামাযানে সাদাকা করার আমল তো বিস্ময়কর৷ এ মাসে যেন তাঁর দানশীলতার জোয়ার সৃষ্টি হতো৷
    ইবনু আব্বাস রাযি. বলেন-

    قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ وَكَانَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَم يَلْقَاهُ كُلَّ لَيْلَةٍ فِي رَمَضَانَ حَتَّى يَنْسَلِخَ يَعْرِضُ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْقُرْآنَ فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَم كَانَ أَجْوَدَ بِالْخَيْرِ مِنْ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ
    অর্থ: রামাযানে জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাত করতেন। আর নবী ﷺ তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরীল যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি প্রেরিত প্রবল বায়ুর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-১৯০২)

    রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হলো-

    أَيُّ الصَّدَقَةِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: صَدَقَةٌ فِي رَمَضَانَ
    অর্থ: কোন (সময়ে) সাদাকা করা উত্তম? তিনি বললেন: রামাযান মাসের সাদাকা। (তিরমিযী হাদীস নং-৬৬৩)

    আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ এই বিধান যথাযথ নিয়ম মেনে পালনের তাওফীক দান করুন৷ আমীন৷